চিরঞ্জীব রায়: ১৬ জুলাই, বুধবার, ইয়েমেনে ব্যবসার অংশীদারকে খুনের অপরাধে ফাঁসি হওয়ার কথা ছিল কেরলের কোল্লেনগোড়ের বাসিন্দা নিমিশা প্রিয়া-র। শেষ মুহূর্তে হয়তো তাঁর প্রাণ বাঁচিয়ে দিতে পারে ‘ব্লাড মানি’, বা বলা যায়, ‘রক্তের দাম’-এর প্রথা।
২০০৮ সালে নার্সের কাজ করতে ইয়েমেনের সানায় যান ৩৬ বছরের নিমিশা। কিছু দিন পরেই তিনি একটি ক্লিনিক খোলার পরিকল্পনা করেন। ইয়েমেনের আইন অনুযায়ী, যে কোনও ব্যবসায় একজন স্থানীয় অংশীদার থাকা বাধ্যতামূলক। তাই নিমিশা সে-দেশের নাগরিক তালাল আবদো মাহদি-কে সঙ্গে নেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তাঁদের সম্পর্ক খুব অশান্তির হয়ে দাঁড়ায়। নিমিশার অভিযোগ ছিল, মাহদি তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন, ব্যবসার টাকা চুরি করেন। এমনকী, তাঁর পাসপোর্ট কবজা করে মাহদি নিজেকে নিমিশার স্বামী বলে দাবি করছেন।
নিজের পাসপোর্ট উদ্ধার করে মাহদির কবল থেকে বাঁচতে ২০১৭ সালে তাঁকে কেটামাইন খাইয়ে অচৈতন্য করতে চান নিমিশা। কিন্তু ওষুধের ডোজ বেশি হয়ে যায়, এবং মাহদি মারা যান। উদ্ভ্রান্ত নিমিশা– হানান নামে এক সহকর্মীর সঙ্গে একজোট হয়ে, মাহদি-র দেহ খণ্ড-খণ্ড করে বস্তায় পুরে ফেলে দিয়ে আসেন। কিন্তু অপরাধ চাপা থাকেনি। নিমিশা গ্রেফতার হন। ২০১৮ সালে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসির সাজা শোনানো হয়। মৃত্যুদণ্ডর তারিখ ধার্য হয়, ১৬ জুলাই, ২০২৫। এবং এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে ‘ব্লাড মানি’-র আইন। ‘কিসাস’-এর ভিত্তিতে শরিয়তি আইনে ‘চোখের বদলে চোখ’ অর্থাৎ, প্রতিশোধের নীতি স্বীকৃত। সেই নিরিখে খুনের বদলে নিহতের পরিবার অপরাধীর শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদণ্ড চাইতে পারে। তবে শরিয়া ‘চোখের বদলে চোখ’-এর পরিবর্তে ‘দিয়া’-র সংস্থানও রেখেছে। ‘দিয়া’ অনুযায়ী, নিহত বা ক্ষতিগ্রস্তর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া যাবে। সেটা কীসের মূল্যে? অবশ্যই অর্থের। ‘দিয়া’ তখনই দেওয়া যাবে, যখন ক্ষতিগ্রস্তর পরিবার ‘কিসাস’ বা প্রতিশোধের সিদ্ধান্ত থেকে স্বেচ্ছায় সরে আসবে এবং ‘রক্তের দাম’ নিতে রাজি হবে। ‘ব্লাড মানি’ নেওয়ার যে সিদ্ধান্ত, সেটা রাষ্ট্র বা সরকার বা অন্য কোনও পক্ষই নিতে পারবে না। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী কেবল ক্ষতিগ্রস্তর পরিবার।
যত খুশি খুন-জখম করে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিলেই বেকসুর খালাস? আইন ততটা উদাসীন নয় মোটেই। ক্ষতিগ্রস্তর পরিবার ‘দিয়া’ মেনে নেওয়া মানেই দোষী সাজামুক্ত হবে কি না, তা নিয়ে দেশ-কাল ভেদে তফাত আছে, বিতর্কও আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসলামীয় আইনশাস্ত্র এই বিষয়টি বিশেষ খোলসা করেনি। সেক্ষেত্রে ‘দিয়া’-দান এবং পরবর্তী পরিণতি উদাহরণ হিসাবে দেখলে এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যেতে পারে। এমন উদাহরণ আছে, যেক্ষেত্রে ‘দিয়া’-র জেরে অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড রদ হয়েছে, কিন্তু কারাবাস মকুব হয়নি।
এমন ঘটনার একটা বড় উদাহরণ, ওই কেরলেরই বাসিন্দা আবদুল রহিম। নিয়োগকর্তার কিশোর ছেলেকে খুনের দায়ে সৌদি আরবে কর্মরত রহিমকে ২০০৬ সালে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। দীর্ঘ ১৮ বছর পরে ২০২৪ সালের ৩ মে নিহতের পরিবার ৩৪ কোটি টাকা ‘ব্লাড মানি’-র বিনিময়ে রহিমকে ক্ষমা করে। তা সত্ত্বেও তাঁর ২০ বছরের জেল হয়। যদিও গত ১৯ বছর কারাবাসেই থাকার দরুন সামনের বছর রহিমের ছাড়া পাওয়ার কথা।
‘ব্লাড মানি’-র প্রথা সাম্প্রতিকের নয়। বহু যুগ আগে ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দীতেও জনজাতির মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে চলতে থাকা আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণ এবং তার জেরে প্রাণহানি থামাতে সোনা, রুপা, উট, পশম ইত্যাদিতে রক্তের দাম দেওয়ার প্রথা ছিল। একজন ভারতীয় ‘ব্লাড মানি’ পেয়েছে, সে নজিরও আছে। ২০০৯ সালে আরব আমিরশাহিতে কেরলের প্রবাসী এ. এস. শঙ্করনারায়ণ তাঁরই বাড়িতে এক বাংলাদেশি ইলেকট্রিক মিস্ত্রি মারা যাওয়ার জেরে জেলে যান। তাঁর মুক্তির পরিবর্তে ৪৭ লক্ষ টাকা দিয়া ধার্য হয়। শঙ্করনারায়ণের ক্ষমতা ছিল না এত টাকা দেওয়ার। ‘এমিরেটস ইসলামিক ব্যাঙ্ক’ সে টাকা দিয়ে দেয়। আট বছর পরে মুক্তি পান তিনি। ভারতীয়দেরই ‘রক্তের দাম’ দিয়ে রেহাই পাওয়ার এমন ঘটনা বহু। এখন সকলের নজর নিমিশার পরিণতির দিকে। দু’টি শর্তের উপর ঝুলে আছে তাঁর মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পাওয়া। প্রথম ও অতি জরুরি শর্ত: মাহদি-র পরিবারের ‘ব্লাড মানি’ নিয়ে ফাঁসি রদে রাজি হওয়া।
দ্বিতীয় শর্ত, বিরাট অঙ্কের ‘ব্লাড মানি’-র জোগাড়। ১৬ জুলাই ফাঁসি নির্দিষ্ট ছিল। অবশেষে, যেখানে নিমিশা জেলবন্দি, সেই ইয়েমেনের সানা-র আকাশে বোধহয় আশার সূর্য উঠেছে। ক্ষতিপূরণ নিয়ে ক্ষমা করতে একেবারেই নারাজ থাকা নিহতের পরিবারের সুর নরম হয়েছে। ১৫ তারিখ শেষ রাতে, অর্থাৎ ফাঁসির কয়েক ঘণ্টা আগে মাহদি-র ভাই মামলা শুরু হওয়ার পরে, প্রথমবার এসে আলোচনায় বসেন। কেরলের নার্সকে বাঁচাতে ২০২০ সালে ‘সেভ নিমিশা প্রিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকশন কাউন্সিল’ সংগঠিত হয়। সেই সেভ নিমিশা কাউন্সিলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, পেশায় আইনজীবী, সুভাষ চন্দ্রন জানিয়েছেন, ‘সারা রাত আলোচনা হয়েছে। ভোরের দিকে ফাঁসি পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আমরা যা চেয়েছিলাম, পেয়েছি। মাহদির পরিবারকে রাজি করানোর আরও একটু সময় হাতে এসেছে।’
প্রসঙ্গত, কাউন্সিল তখন থেকেই সম্ভাব্য ‘ব্লাড মানি’ জোগাড় করতে উঠে-পড়ে লাগে। ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে ৪০ হাজার ডলার জোগাড়ও হয়ে যায়। কাউন্সিলের অনুমান, ক্ষতিপূরণের অঙ্কটা চার লক্ষ ডলারে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। নিমিশার প্রাণরক্ষায় ভারতীয় সরকার যথেষ্ট তৎপর হয়েছিল। কিন্তু মুশকিল হয়ে যায়, সানা এলাকা হাউথি গোষ্ঠীর দখলে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনে সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষে রত হাউথি প্রশাসনের সঙ্গে ভারত সরকারের কূটনৈতিক সম্পর্ক যথেষ্ট সীমাবদ্ধ। কেন্দ্র ১৪ জুলাই সুপ্রিম কোর্টকে জানায়, নিমিশার প্রাণদণ্ড রুখতে সমস্ত কূটনৈতিক উপায় নিলেও কোনও ফল হয়নি। অতঃপর বেসরকারি স্তরে চেষ্টা চলছে। এই ‘বেসরকারি’ উপায়: কান্তাপুরম এ. পি. আবুবকর মুসলিয়র, একজন খ্যাতনামা ভারতীয় মুসলিম ধর্মগুরু। তিনিই কেরলের মারকাজের মাধ্যমে সানার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেন। এবং তারই ফলাফল হল, রাতারাতি মাহদির পরিবারের আলোচনার টেবিলে আসতে রাজি হওয়া।
সুভাষ চন্দ্রন বলছেন, এখানকার আদালতের আর কিছু করার নেই। আর কোনও শুনানি হবে না। এখন পুরোটা নির্ভর করে আছে মাহদি-র পরিবারের উপর। একমাত্র তারাই দিয়া নিয়ে নিমিশাকে বাঁচাতে পারে। তা না হলে...। শুধু সুভাষ চন্দ্রন নন, এই মুহূর্তে সমস্ত ভারতবাসীই প্রার্থনা করছে, মাহদির পরিবার ‘রক্তের দাম’ নিতে রাজি হোক। ঘরের মেয়ের প্রাণটা অন্তত বাঁচুক।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
chiranjibray67@gmail.com
