পণের বদলে মেয়ের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার কথা বললেন ঠাকুর কাঁওয়ার অজয় প্রতাপ সিং। কিন্তু তাতে আদৌ কমবে বধূ নির্যাতন? বিয়ে যেন গড়ে ওঠে পারস্পরিক ভালবাসার উপর। আগ্রাসী অধিকার-বোধের উপর নয়। তবেই কমবে শ্বশুরবাড়িতে নারী-নির্যাতন।
সম্প্রতি, দিল্লির কাছে নয়ডা অঞ্চলে নিক্কি ভাটিকে গায়ে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে মারা হয়। কোন অপরাধে নিক্কির শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এভাবে পুড়িয়ে মারল তাকে? নিক্কির বাবা নিক্কির বিয়েতে যথেষ্ট মূল্যবান পণ দিয়েছিলেন। কিন্তু নিক্কির শ্বশুরবাড়ির চাহিদার শেষ ছিল না। বছরের-পর-বছর ধরে যত পণ তারা পেয়েছে, ততই বেড়েছে তাদের চাহিদা। শেষ পর্যন্ত শ্বশুরবাড়ির ক্রমশ বেড়ে ওঠা লোভ নাকি দায়ী নিক্কির এই নির্মম মৃত্যুর জন্য। সমস্ত দেশ জুড়েই ক্রমশ বাড়ছে পণের দাবি না মেটাতে পারার জন্য শ্বশুরবাড়িতে মেয়েদের নির্যাতন ও হত্যা।
‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বু্যুরো’-র তথ্য বলছে, ২০১৭ থেকে ’২২-এর মধ্যে ৭ হাজারের বেশি বধূহত্যা ঘটেছে পণের জন্য। ‘ন্যাশনাল কমিশন ফর উইমেন’ ২০২৪-এ শ্বশুরবাড়িতে নারী নির্যাতনের যত অভিযোগ পেয়েছে, তার ১৭ শতাংশ পণের জন্য। এবং ২০২৪ সালে পণ্যের জন্য হত্যা সংখ্যা ২৯৪। এ তো সব অফিসিয়াল হিসাব। আসলে আরও অনেক বেশি ঘটে পণের জন্য অত্যাচার ও খুন।
সারা ভারত জুড়ে এবং বিশেষভাবে উত্তরপ্রদেশে বিয়ের পণ আদায়ের জন্য নারী নির্যাতন ও নিধনের প্রতিবাদে সম্প্রতি গর্জে উঠলেন ‘অল ইন্ডিয়া ক্ষত্রিয় মহাসভা’-র প্রেসিডেন্ট ঠাকুর কঁাওয়ার অজয় প্রতাপ সিং। ২৪ অাগস্ট রবিবার উত্তরপ্রদেশের বাগপত্ অঞ্চলে ঠাকুর সম্প্রদায়ের এক জমায়েতে অজয় প্রতাপ সিং বলেন, ‘বিয়েতে পণ দেওয়া বন্ধ করুন। সোনা-রুপো-টাকা, আর মূল্যবান যৌতুক দিয়ে কী লাভ? তাতে মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোভ আরও উসকে দেওয়া হয়। এবং শেষ পর্যন্ত চাহিদার শেষ থাকে না। আর তখন চাহিদা না মেটাতে পারলে, পণ-দাবির অত্যাচার বাড়তেই থাকে। তার চেয়ে ঢের ভালো, যার যেমন সামর্থ্য, মেয়ের হাতে অস্ত্র তুলে দিন। ছোরা, তরোয়াল, রিভলভার, যার যেমন ক্ষমতা।’
এ-কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আবেগের হাততালিতে বিরাট জমায়েত ভেসে যায়। কিন্তু এ তো গেল আবেগের কথা। সংসার তো যুদ্ধক্ষেত্র নয়। সংসার গড়ে ওঠে নারীর মায়া-মমতা, স্নেহ, যত্ন, সেবা ও প্রেমের ওপর। অঁাচলে রিভলভার বেঁধে সংসার করা কি সম্ভব? পণপ্রথার বিরুদ্ধে আসল অস্ত্রটি হওয়া চাই আমাদের শিক্ষাদীক্ষা ও সমাজব্যবস্থা-প্রসূত পণবিরোধী মানসিকতা। এবং অজয় প্রতাপ সিং আক্ষরিক অর্থে মেয়েদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে তাদের শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর কথা বলেছেন বলেও তো মনে হয় না। কারণ, পুরুষ শাসিত সমাজে বধূর ছোরা বা তরোয়াল শ্বশুরবাড়ির হাতে উঠতে কতক্ষণ? আসলে, আমাদের যা চাই, তা হল সমাজের মধ্যে মূল্যবোধ-প্রসূত মানবিকতার প্রকাশ। যে-কোনও রকম পণ দাবি যেন হয়ে ওঠে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিয়ে উপলক্ষে কোনও বহুমূল্য উপহারও বর্জনীয় হয়ে ওঠা উচিত। বিয়ের উৎসব যেন হয় শর্ত মুক্ত, দাবি মুক্ত মিলনের উদ্যাপন। বিয়ে যেন গড়ে ওঠে পারস্পরিক ভালবাসার উপর। আগ্রাসী অধিকার-বোধের উপর নয়। তবেই কমবে শ্বশুরবাড়িতে নারী-নির্যাতন।
