shono
Advertisement

একুশের রাজনীতি

২০২০ বিদায়ের মুখে কেউ কেউ এমন ভাব করছিলেন, যেন ’২১ সাল এলেই ‘বিষ-মুক্ত’ হবে সমাজ।
Posted: 04:36 PM Jan 06, 2021Updated: 04:36 PM Jan 06, 2021

কিংশুক প্রামাণিক: ২০২০ বিদায়ের মুখে কেউ কেউ এমন ভাব করছিলেন, যেন ’২১ সাল এলেই ‘বিষ-মুক্ত’ হবে সমাজ। করোনার প্রকোপ, মৃত্যু- সবকিছু থেকে রেহাই মিলবে। মাস্ক, স্যানিটাইজার, ‘সামাজিক দূরত্ববিধি’ থাকবে না। ফিরে আসবে সেই স্বাভাবিক জীবন।

Advertisement

বাস্তবে তা কী করে সম্ভব! অতিমারী তো আর রূপকথার গল্পগাথা নয় যে জিয়নকাঠি-মরণকাঠি থাকবে। ইচ্ছামতো ভাইরাসকে ঘুম পাড়ানো যাবে। আবার দানবের মতো জাগানোও যাবে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, ভাইরাস নিজের মতো আসে, ধ্বংসলীলা চালায়, আবার একদিন আচমকা চলে যায়। মাঝে পড়ে থাকে বিবর্ণ সময়। যা হিরোশিমার মতোই কান্না হয়ে ঘুরে বেড়ায় অসহায় মানবজীবনে।

[আরও পড়ুন: লাদাখ সীমান্তে ‘অপ্রচলিত অস্ত্র’ ব্যবহার চিনের, জানাল প্রতিরক্ষামন্ত্রক]

এবারও একইরকম পটভূমি, নতুন মোড়কে। নতুন বছরে আতঙ্ক হয়ে উদয় হয়েছে করোনার নতুন ‘স্ট্রেন’। অতি-সংক্রামক এই ভাইরাস আরও বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে আশঙ্কা। তাই ইউরোপে আবার শুরু হয়ে গিয়েছে লকডাউন। লন্ডন আবার নিস্তব্ধনগরী। ভারতেও সেই স্ট্রেনের হদিশ পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু তাতে এদেশের মানুষের কিছু যায়-অাসে বলে মনে হয় না। হাল্লা রাজার দেশে করোনাকে গিলে ফেলেছে যেন মানুষ। কী করে কী হল, কেউ জানে না। যদিও বাস্তবে সংক্রমণ কমছে রাজ্যে, দেশে। স্বভাবতই করোনা আর ইস্যু নয়। বাতাসে রাজনীতির উত্তাপ দেখে
বরং মনে হচ্ছে, একুশের সবচেয়ে বড় ইস্যু– বাংলার বিধানসভা ভোট আগত।

নতুন বছরও শুরু হল খারাপ খবর দিয়েই। হৃদয়ে সংঘাত। স্বয়ং মহারাজ শয্যাশায়ী। বাড়িতে অভ্যাসমতো ট্রেডমিলে হাঁটতে হাঁটতে ব্ল্যাক আউট হয়ে পড়েন যুবসমাজের আইকন। হাসপাতালে আনার পর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের (Sourav Ganguly) হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লকেজ দেখে চক্ষু চড়কগাছ ডাক্তারদের! গুলির মতো ছুটে আসা বল মুখের সামনে থেকে যিনি মাটিতে নামাতেন, স্টেপ আউট করে ম্যাকগ্রা, শোয়েব আখতারদের বল স্টেডিয়ামের বাইরে পাঠিয়ে দিতেন, ক্ষিপ্রতার সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে ক্যাচ নিতেন, বডি ছুড়ে নিশ্চিত চার বাঁচাতেন– তাঁর বুকে কিনা ব্লকেজ! প্রমাদ গুনছে সবাই। সৌরভের মুখ-হাসি, চেহারা-চালচলন চিরকাল এতটাই সপ্রতিভ- যে মনেই হয় না তাঁর শরীরে রোগ থাকতে পারে। তার চেয়ে বড় কথা, এই ৪৮ সালে এসে সাফল্য ও বৈভবের শিখরে বিরাজমান মহারাজের জীবনে নেই একফোঁটা অসংযম। সেই লর্ডসের মাঠ থেকে আজ, একইরকম শৃঙ্খ‌লায় মোড়া। পরিমিত খাওয়া, নিয়মিত শরীরচর্চা তাঁর রুটিন। মদ্যপান, ধূমপান অথবা অন্য নেশা তাঁর আছে বলে কেউ জানে না। রাতভর পার্টি, হইচই, বেহিসাবি জীবন থেকে তিনি বরাবর দূরে। মাঠে যতটা দামাল, মাঠের বাইরে ততোধিক লক্ষ্মী ছেলে।

সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের জন্য যা যা দরকার, তা করার পরও যখন সৌরভের হার্ট অ্যাটাকের খবর সামনে এল, তখন একুশ সাল নিয়ে উদ্বাহু হওয়া অনেকের মনে প্রশ্ন– জীবনের নিরাপত্তা কোথায়? সৌরভ যদি বুকে ব্যথা নিয়ে এই বয়সে নার্সিংহোমে ভর্তি হন, তাহলে অন্যদের কী হবে? সৌরভ নিয়ে আলোচনায় আরও একটি পর্ব এই পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বেশ কিছুদিন ধরে য়ালোচনা চলছে, তিনি কি এবার রাজনীতিতে নামছেন? যোগ দিচ্ছেন কোনও দলে? হঠাৎ করে অসুস্থতার পর বিষয়টি নতুন মাত্রা পেয়েছে।

বিজেপিতে কি যাচ্ছেন? সত্যি তিনি আগ্রহী? অফারটা কি? সৌরভ চুপ। কোথাও বলেননি তিনি রাজনীতিতে আসছেন। তাঁর অতি-ঘনিষ্ঠ অনেকেই নাকি এই প্রশ্নটির উত্তরে ‘না’ শুনেছেন। এরপর কেউ কেউ মনে করছেন, সৌরভ যদি ‘অফার’ পানও এখনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি। তদুপরি হাওয়ায় ভাসে রাজনীতির কথা। কোনও প্রমাণ না থাকলেও নানা ঘটনার ঘনঘটায় জল্পনা তুঙ্গে। এমনকী, গেরস্থের হেঁশেলেও খবর, ‘দিদি’-র বিরুদ্ধে ‘দাদা’-কে মুখ্যমন্ত্রী পদে প্রোজেক্ট করতে চাইছে ভারতীয় জনতা পার্টি।

মমতাকে মুখ্যমন্ত্রী পদে চ্যালেঞ্জ জানাতে ‘বিকল্প’ মুখ চাই। বিজেপি তেমন একজনকেই চাইছে। কারণ, দলের নেতৃত্ব অথবা তৃণমূলের যেসব নেতা আসছেন– তাঁরা কেউ মমতার ‘বিকল্প’ নন। অনেক ভেবেই নাকি ‘পছন্দ’ মহারাজ। রাজনীতির বাইরের লোক হলেও দেশে সৌরভের গুরুত্ব অপরিসীম। সেজন্য বিসিসিঅাই প্রেসিডেন্ট পদে বসা মসৃণ হয়েছে তাঁর। সম্প্রতি রাজ্যপালের সঙ্গে রাজভবনে গিয়ে বৈঠক ও পরে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর কর্মসূচিতে যোগ দেওয়া তঁাকে ঘিরে জল্পনায় বাড়তি মাত্রা দিয়েছে। সবাই যখন মনে করছেন, মহারাজ পদ্মাসনে বসলেন বলে, তখনই বেহালার বাড়ি থেকে করুণ সুর। হার্ট অ্যাটাক হার্টথ্রবের।

আচমকা এই ঘটনা আবার বিতর্ক উসকে দিয়েছে। তরতাজা ৪৮ বছরের সৌরভের হার্ট অ্যাটাক হল কেন? তাঁর উপর কি কোনও মানসিক চাপ ছিল? অত্যধিক স্ট্রেস থেকে হৃদরোগ যখন দস্তুর। আবার এ-ও ঠিক, ক্রিকেটের বাইশ গজে চাপ তো কিছু কম নেননি ভারত অধিনায়ক, তাঁর কাছে এসব নতুন কী? জল্পনা কতটা সত্য, কতটা মিথ্যা– তা জানা যাচ্ছে না। তবে মহারাজের অসুস্থতার পর বিজেপির সর্বস্তরের নেতাদের যেরকম তৎপরতা ও উদ্বেগ দেখা গেল, তার থেকে স্পষ্ট, কিছু একটা ঘটছে। কেউ কেউ তো বলেই ফেললেন, ক’দিন আগে বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক কপিল দেব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তখন কি এতটা তৎপরতা কেন্দ্রের শাসক দলের নেতৃত্বর ছিল?

সাধারণত অনেক রাজে্যই মুখ্যমন্ত্রী পদে কাউকে প্রোজেক্ট না করে বিধানসভা ভোটে লড়েছে বিজেপি। সাফল্যও পেয়েছে। বাংলাতেও ইতিপূর্বে বলা হয়, জিতলে ভূমিপুত্রই কেউ মুখ্যমন্ত্রী হবেন। মুখে একথা বললেও, বাস্তবে বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃত্ব একজন মুখ খুঁজছে একটাই কারণে– উলটোদিকের মুখটির নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যাঁর ব্যক্তিগত কাজ, গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার উপর দাঁড়িয়ে আছে তৃণমূল সরকার ও তৃণমূল কংগ্রেস দলটি। বঙ্গ-রাজনীতিতে বিধানসভা নির্বাচনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, অধিকাংশ সময়ই শাসক ও বিরোধী দুই শিবির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থীকে সামনে রেখেই ভোটে লড়েছে। যেমন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর ‘বিকল্প’ ছিলেন মমতা বন্দে্যাপাধ্যায়। প্রকাশে্যই ছিল সেই প্রচার। ২০০১, ২০০৬, ২০১১– তিনটি ভোটে মমতা-বুদ্ধ লড়াই হয়েছে। জে্যাতি বসু-সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মধ্যেও একাধিক নির্বাচনে লড়াই ছিল, কে মুখ্যমন্ত্রী পদে বসবেন, তা নিয়ে। এমনকী, বিধানচন্দ্র রায় যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তাঁর ‘বিকল্প’ মুখ ছিলেন বিরোধীদের নেতা জ্যোতি বসু। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সরাসরি না বললেও, বাম-কংগ্রেস জোট সূর্যকান্ত মিশ্রকে সামনে রেখেছিল। স্বভাবতই বিজেপিকেও ভাবতে হচ্ছে– ‘নরেন্দ্র মোদির হাতে বাংলা তুলে দিন’, এই স্লোগান থাকবে, না কি কাউকে প্রোজেক্ট করা হবে? সেই অঙ্ক থেকেই কি সৌরভ? জল্পনা রয়ে গেল। আচমকা মহারাজের অসুস্থতায় আপাত চাপা পড়ল জরুরি কথাগুলো।

[আরও পড়ুন: উত্তরপ্রদেশের লাভ জেহাদ বিরোধী আইন কি আদৌ বৈধ? খতিয়ে দেখবে সুপ্রিম কোর্ট]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement