জিম্বাবোয়ের সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে খরা ও অনাহার থেকে দেশের মানুষকে বাঁচাতে ২০০টি হাতিকে মেরে ফেলা হবে। আফ্রিকায় হাতিশিকারের ঐতিহ্যটি পুরনো, তবে এইভাবে বন্যপ্রাণের প্রতি আক্রমণ অবাক করে! লিখছেন সুমন প্রতিহার।
জিম্বাবোয়েতে (Zimbabwe) এখন– তীব্র খরা, খিদে, দুর্ভিক্ষ। বিপর্যয়ের এই ত্রিশূল থেকে বঁাচতে সে-দেশের সরকার স্থির করেছে ২০০টি বন্য হাতিকে মেরে ফেলা হবে। তিনাশে ফারাও, জিম্বাবোয়ের বন্যপ্রাণের মুখপাত্র, বলছেন, সে-দেশে ৪৫ হাজার হাতি বহাল তবিয়তে থাকতে পারে। সংখ্যাটি নাকি এখন বাড়তে বাড়তে ৮৪ হাজার। তাই ভাবসাব এমন– মাত্র ২০০টি হাতি তো মেরে ফেলা হবে, এর জন্য এত হাঙ্গাম কেন!
হোয়াঞ্জ, জিম্বাবোয়ের সবচেয়ে বড় জাতীয় উদ্যান। সেখানে রয়েছে ৬৫ হাজার হাতি। কোন অঞ্চলের হাতিদের নিকেশ করা হবে আলোচনায় ঠিক হয়েছে সেটাও। প্রাধান্য পাবে এমন-এমন ‘জোন’ যেখানে হাতিরা মানুষের সঙ্গে প্রায়শই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ সিদ্ধান্তের অভিমুখ, দৃষ্টিকোণ সবটাই মানুষের পাশে দঁাড়িয়ে। প্রতিবেশী দেশ নামিবিয়া সেপ্টেম্বর মাসেই ১৭০টি বন্যপ্রাণীকে সিদ্ধান্ত নিয়ে মেরেছে। আরও ৭০০ বন্যপ্রাণীকে হত্যা করার পরিকল্পনা করা রয়েছে। যার মধ্যে ৮৩টি হাতি।
এত হাতি মারা হবে কেন? উত্তর: মাংসের জন্য। সরকার ঠিক করেছে– প্রথমে হাতির মাংস শুকিয়ে, প্যাকেটজাত করা হবে, অতঃপর পাঠানো হবে জিম্বাবোয়ের ক্ষুধার্ত নানা প্রান্তিক জনজাতির কাছে। রাষ্ট্র সংঘের রিপোর্ট বলছে: সেই দেশের ১০০ জন প্রতি ৪২ জনের অপুষ্টি।
তথ্য বলছে, ২০০৫ সালে, কঙ্গোর একটি হাতিকে চোরাশিকারিরা শিকার করেছিল দঁাতের জন্য নয়, মাংসের জন্য মাত্র। দঁাত উপরি পাওনা। প্রাপ্তবয়স্ক একটি হাতি থেকে প্রায় ২,৫০০ হাজার কিলোগ্রাম মাংস পাওয়া যেতে পারে। কঁাচা মাংসের তলায় আগুন জ্বালিয়ে, হালকা সেঁকে নিলে, মাংসের পচন রোধ করা যায়। আর সেই মাংস ছোট-ছোট ঝুড়িতে ভরে দূর-দূরে বাজারে বিক্রি করতে সুবিধাও হয়। মধ্য আফ্রিকার নানা গঞ্জে বিক্রি হয় হাতির মাংস কিলো প্রতি ১০ ডলারে। শুধু হাতি নয়, হইহই করে বিক্রি হয় বঁাদরের মাংস। তবে দাম অনেকটাই কম, কিলো-প্রতি ১ ডলারও নয়। মাংসের বাজারের পাশাপাশি রয়েছে হাতির দঁাতের সমৃদ্ধ বাজার।
১৮ লক্ষ বছর আগে, জর্জিয়ায় প্রথম হাতির মাংস খাওয়া হয়েছিল বলা হলেও, সেটি নিশ্চিত ‘হাতি’ নয়, ম্যামথ। পূর্ব আফ্রিকায় জংলি হাতিশিকারের প্রমাণ রয়েছে ১০ লক্ষ বছর আগে। জার্মানিতে রয়েছে প্রথম হাতিশিকারের দৃষ্টান্ত। উনিশ শতকে আফ্রিকায় মবুটি পিগমিরা ছোট-বড় দলে হাতিশিকার করত কাঠের ফলা দিয়ে। নির্দিষ্ট হাতিটিকে ধাওয়া করে, পিছনের পায়ের হঁাটু লক্ষ্য করে গেঁথে দিত সে-ফলা। বিশ শতকের গোড়ায় পিগমিরা ব্যবহার করেছে বল্লমের মুখে লোহার ফালা, তাতে সহজে কাবু হত হাতি ও অন্যান্য শিকার। হাতিশিকারের আগে হত জব্বর নাচ।
হাতিশিকার বেশ সময়সাপেক্ষ। শিকারিরা কাদামাটি, হাতির মল, চারকোল মেখে মানুষী গন্ধ মুছতে চায়। হাতিকে লক্ষ্য করা থেকে পিছু নিয়ে শিকার করতে সপ্তাহখানেকও লেগে যেতে পারে। অনেক সময় আহত হাতির মৃত্যুও হয় না সহজে। শিকারি দল এই পুরো সময় মধু ও ফলমূলের ভরসায় দিন চালায়। কঙ্গোর বাকা উপজাতির সদস্যরা হাতিশিকারের পর বনভোজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে– এমন নিদর্শন আছে। অদ্ভুত
তাদের রীতি, শিকারির নিকটাত্মীয়রা সেই পার্টিতে অংশ নিতে পারবে না। আধুনিক চোরাশিকারিরা হাতি মারতে ব্যবহার করে অত্যাধুনিক কালাশনিকভ রাইফেল।
প্রতি ১০০ গ্রাম হাতির মাংসে সাড়ে ৮.৪ গ্রাম প্রোটিন, ১.৫ গ্রাম ফ্যাট, ৪৩.৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৩৫.৭ গ্রাম ফাইবার রয়েছে। ভিটামিন বি, সি, আয়রন, প্রোটিন সবই গরুর মাংসের চেয়েও বেশি। শুয়োরের মাংসের তুলনায় ফ্যাটের পরিমাণ প্রায় এক। একপক্ষের ধারণা– হাতির পা, লেজ আর জিভের মাংস সুস্বাদু। বাকি মাংস নাকি তন্তুময়। হিন্দু ধর্মে হাতি দেবতুল্য, তাই মাংসভক্ষণ নৈব নৈব চ। মুসলিমদের বিধানেও হাতির মাংস বারণ। ইহুদিদের নিয়মে যেসব প্রাণীদের চেরা ক্ষুর থাকে না, তাদের মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ, অতএব হাতি বাদ। আবার চিনারা নাকি বিশ্বাস করে হাতির মাংস খেলে মাথায় চুল গজায়।
জিম্বাবোয়ের পরিবেশমন্ত্রী পার্লামেন্টে চোয়াল চেপে বলেছেন, দেশের বনে-বনে হাতি উপচে পড়ছে, দুর্ভিক্ষের এই কঠিন সময়ে মানুষে-হাতিতে নিত্য সংগ্রাম চলছে। তাছাড়া, এ-বছর হাতির হানায় জিম্বাবোয়েতে ৩১ জনের মৃত্যুও হয়েছে। তাই সিদ্ধান্ত– ২০০টি হাতি মেরে ফেলার। সংরক্ষণবিদরা হাতির বেঁচে থাকার অধিকারের সপক্ষে কণ্ঠ ছেড়েছেন বটে, কিন্তু কেউ শুনলে তো সে-কথা!
(মতামত নিজস্ব)
লেখক অধ্যাপক, কেশপুর কলেজ
pratihar_vu@rediffmail.com