shono
Advertisement

বাংলার রঙ্গমঞ্চ তাঁকে ভুলবে না, নটী বিনোদিনীকে স্মরণ সুবোধ সরকার, গৌতম হালদারদের

বারো বছরের অভিনয় জীবনে ষাটটির বেশি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বিনোদিনী।
Posted: 03:53 PM Dec 25, 2022Updated: 05:15 PM Dec 25, 2022

কিশোর ঘোষ: আহ্নিক গতির হিসেব বলছে ২৫ ডিসেম্বরে রাত বড় হয়, দিন হয় ছোট। যদিও এই দিনটাই গোটা বিশ্বের কাছে ‘বড়দিন’! কেন, সকলের জানা। তার মানে দিন ছোট বা বড় হয় না আদৌ, তেমন তেমন মানুষ নিজের অর্জনে বড় করে তোলে দিন-ক্ষণ-সময়! যেমন নটী বিনোদিনী (Nati Binodini)। কিন্তু ১৮৮৬ সাল। ২৫ ডিসেম্বর। নাট্যজগতকে হতচকিত করে অভিনয় থেকে আচমকা বিদায় নিয়েছিলেন। অথচ তখন বাংলা রঙ্গমঞ্চের খ্যাতির শীর্ষে তিনি। তবে কেন অবসর? সে এক রহস্য। অন্ধকার থেকে আলোকযাত্রার রহস্য! আসল কথা, এর ফলে ২৫ ডিসেম্বর বাংলা রঙ্গমঞ্চেরও ‘বড়দিন’ হয়ে গেল! তবে খানিক বিষাদের বড়দিন। নাট্য জগতের একাংশের বক্তব্য, ততদিন বড়কাজ সেরে ফেলেছেন বিনোদিনী। অভিনয় শৈলীর ভিত গড়ে দিয়েছেন মাস্টারমশাই গিরিশ ঘোষের (Girish Ghosh) সাহচার্যে। এই বিষয়ে একমত বঙ্গীয় থিয়েটারের আজকের অন্যতম প্রধান অভিনেতা গৌতম হালদার (Goutam Halder), সমকালীন বাংলা কবিতার প্রতিনিধি সুবোধ সরকার (Subodh Sarkar)।

Advertisement

এককালে নাটকে ও সিনেমায় ‘নামত’ অভিনেতারা। যে কাজে চরিত্র পতনের সম্ভাবনা! সেই গ্রাফ বদলে দেন বিনোদিনী দাসী। নিষিদ্ধপল্লীর পরিবেশে ১৮৬২ সালে জন্ম। সেই মানুষটাই ঊনবিংশ শতকের বাংলা রঙ্গমঞ্চের কিংবদন্তি অভিনেত্রী। মঞ্চে প্রথম অভিনয়ের সুযোগ পান ১৮৭৪ সালে। ‘বেণীসংহার’ নাটকে দ্রৌপদীর সখীর ভূমিকায়। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি। ফলে আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি সুবোধ যখন বলেন, “বিনোদিনীর অবদান যিনি ভোলেন, সেটা তাঁর সমস্যা।” তখন যে ঠিক বলেন বলেই মনে হয়।

[আরও পড়ুন: ২৫ ডিসেম্বরই ছিল শেষ অভিনয়, মাত্র বাইশেই মঞ্চকে বিদায় জানান নটী বিনোদিনী]

উল্লেখ্য, বঙ্গীয় রঙ্গমঞ্চ থেকে নটী বিনোদিনী আচমকা ‘সন্ন্যাস’ নেন বটে, তবে এর পরে সাহিত্য সাধনায় মন দিয়েছিলেন। নিভৃতে শুরু করেছিলেন কবিতা লেখা। ১৮৯৫ সালে গিরিশ ঘোষ সম্পাদিত সৌরভ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল বিনোদিনীর লেখা ‘হৃদয়রত্ন’ ও ‘অবসাদ’ নামে দু’টি কবিতা, কুড়ি পাতার কাহিনিকাব্য ‘আভা’। তাঁর সম্পর্কে সমকালীন কবি সুবোধের বক্তব্য, “নটী বিনোদিনীকে কে মনে রাখল কে রাখল না, তার থেকেও অনেক বড় কথা, নটী বিনোদিনী ছাড়া বাংলা রঙ্গমঞ্চ কল্পনা কার যায় না। তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। তাঁর আচমকা থিয়েটার মঞ্চ ছেড়ে যাওয়া ছিল ভীষণ দুঃখের, বিষাদের। হতচকিত হয়েছিলেন সেদিনের মানুষ। তবে তিনি মঞ্চ ছেড়ে গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু বঙ্গীয় থিয়েটার, বাংলা ভাষা, অভিনয় শিল্প ছেড়ে কখনও যাননি, তিনি আমাদের সঙ্গেই আছেন।” বঙ্গীয় থিয়েটার ও বাংলা কবিতার যোগসূ্ত্রের মতোই বিনোদিনী ও সুবোধের সম্পর্ক। তাই সর্বকালের অন্যতম সেরা অভিনেত্রীকে নিয়ে কবিতা লেখেন কবি! সুবোধ জানান, “দশ বছর আগে তাঁকে (নটী বিনোদিনী) নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলাম। কিন্তু লেখাটি নিয়ে অতৃপ্ত ছিলাম। তাই ছাপতে দিইনি। বহুবার ভেবেছি ওঁকে নিয়ে আবার একটা কবিতা লিখব। ওকে উৎসর্গ করব। হয়ে ওঠেনি। এই ব্যর্থতাই হয়তো নটী বিনোদিনীর প্রতি আমার শ্রদ্ধা!”

মাত্র বারো বছরের অভিনয় জীবন ছিল বিনোদিনীর। ন্যাশনাল, বেঙ্গল ও স্টার থিয়েটারে মঞ্চস্থ প্রায় পঞ্চাশটি নাটকে, ষাটটির বেশি ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। বাংলা ছাড়াও সংস্কৃত, উর্দু, ফার্সি, এমনকী চোস্ত ইংরেজিতে সংলাপ বলে দর্শকদের চমকে দিতেন ‘অশিক্ষিত’ বিনোদিনী। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি মঞ্চে থাকা মানেই ‘শো’ হাউসফুল। জীবন নিংড়ানো পরিশ্রমের ফসল এই দক্ষতা, বলছেন আজকের বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের চাম্পিয়ান অভিনেতা গৌতম হালদার। নগৌতম বলেন, “বাংলা রঙ্গমঞ্চে গিরিশ ঘোষ এবং নটী বিনোদিনীর অবদান অপরিশিম। বিনোদিনীকে মঞ্চে দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমাদের। তাঁর কথা পড়েছি, শুনেছি। মুগ্ধ হয়েছি। মনে রাখতে হবে, অভিনয় শৈলী উপরে যতই বদলাক, ভেতরটা এক। গুরুত্বপূর্ণ হল একজন অভিনেতা নিজেকে কীভাবে তৈরি করছেন। এক্ষেত্রে এসে পড়ে গিরিশ ঘোষের কথা।”

[আরও পড়ুন: নেশাতুর কেক কিনতে ভিড় অ্যাংলোপাড়ায়, হ্যান্ড মেড ওয়াইনের ঠিকানাও বো ব্যারাক]

গৌতমের সংযোজন, “শিক্ষা দিলেই তো হল না, সকলের তা নেওয়ার ক্ষমতা থাকে না। যেমনটা ছিল বিনোদিনীর। তাই তিনি ক্রমশ উন্নততর অভিনেত্রী হয়ে ওঠেন। মনে রাখতে হবে গিরিশের বহু শিষ্য-শিষ্যা ছিল। সকলে তো বিনোদিনী হয়ে উঠতে পারেননি! আসলে যে যা হয়, নিজের যোগ্যতাতেই হয়। নিজের জ্ঞান, বোধে। শরীরটা হল যন্ত্র। বেহালায় যেমন সুর তোলেন বাদক, তেমন শরীরে যন্ত্রে মন-প্রাণ-বোধ দিয়ে অভিনয়ের সুর বাঁধেন একজন অভিনেতা। তাতে যেমন আবেগ থাকে, তেমনই থাকে চূড়ান্ত পরিশ্রমও।”

গৌতমের কথায়, প্রকৃত অভিনেতা দক্ষতার চূড়ন্তে পৌঁছান নিজেকেই চিনতে চিনতে। আত্মদীপ ভব! “বিনোদিনী তুমুল জীবন যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতেই আলোকিত হয়েছিলেন বলে মনে করি। সেই যন্ত্রণার তীব্রতা আমরা ভাবতেও পারব না। তবে শুরুতে যা বলেছিলাম, অভিনয় শৈলীর মূলগত বিষয়টি কিন্তু এক। একজন দর্শক জানতে পারেন না, একটি চরিত্রে অভিনয়ের পিছনে কতখানি মেধা ও পরিশ্রম থাকতে পারে। তবে দর্শক অনুভব করেন বিষয়টা। ” গৌতমের কথায়, কাজটা সহজ না, সেই কারণেই কয়েক যুগ পর জন্মান একজন নটী বিনোদিনী। এবং বাংলা রঙ্গমঞ্চের জার্নি অব্যাহত থাকে।

সেবার ‘মেঘনাদ বধ’ নাটকে একাই চিত্রাঙ্গদা, প্রমীলা, বারুণী, রতি, মায়া, মহামায়া ও সীতার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন নটী বিনোদিনী। যা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন সে যুগের তাবড় অভিনেতারা। এযুগের গৌতম হালদারের বক্তব্যেও প্রতিভাত সেই বিস্ময়। সেটাই স্বাভাবিক। সেই কারণেই নটীর অভিনয় থেকে অবসরের ১৩৬ বছর পরও তিনি ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক।  

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement