সুচেতা সেনগুপ্ত: জঙ্গলের প্রতিটি আড়াল, আবডাল, বাঁক-মোড় চিনে তার মধ্যে দিয়ে অতি সূক্ষ্ণতার সঙ্গে রাজার মতো চলাফেরা করা, ধরা না দেওয়া - এটাই বাঘের বৈশিষ্ট্য। আর এদেশে বাঘ মানে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। তাকে ধরা সহজ নয় মোটেও। এমনকী সামান্য দূরত্বে থাকলেও তার উপস্থিতি টের পাওয়া মুশকিল। সে জঙ্গল আবার অসমের মানস জাতীয় উদ্যান হলে আরও বাঘের উপস্থিতি টের পাওয়া আরও কঠিন। আর সেই দুরূহ কাজ করার প্রতিজ্ঞায় একটি ক্যামেরা আর গুটিকয়েক সঙ্গীসাথীকে নিয়ে নেমেছেন বাংলার ছেলে আলি আসিফ শেখ। প্রচুর পরিশ্রম করে মানসের জঙ্গলে একমাস ধরে বাঘেদের গতিবিধি ক্যামেরাবন্দি করতে সক্ষম হয়েছে তাঁর টিম। সেসব অভিজ্ঞতার কথাই 'সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল'-এর সঙ্গে শেয়ার করে নিলেন ৩০ বছরের আসিফ। লক্ষ্য তাঁর, মানসে যত রকমের বিরল প্রজাতির প্রাণী রয়েছে, তথ্যচিত্রের মাধ্যমে তাদের জীবনযাপন প্রকাশ্যে আনা।
মানস জাতীয় উদ্যান নিয়ে যে কটি কাহিনি প্রচলিত, তার মধ্যে একটি হল - এখানকার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার নাকি খুব 'লাজুক'। বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, মানসে বাঘের দর্শন অতি বিরল। ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে নাকি তাকে দেখা যায় না। তার উপরে বাঘের গতিবিধি ক্যামেরায় ধরা! কঠিনতর কাজ নিঃসন্দেহে। কিন্তু তথ্যচিত্র তৈরির লক্ষ্য নিয়ে সেই কঠিন কাজে বেশ কিছুটা এগিয়েছেন আসিফ ও তাঁর সঙ্গীরা। গোটা নভেম্বর ধরেই মানসের জঙ্গলে শুটিং করেছেন তাঁরা।
বাঘের পায়ের ছাপ। ছবি: আলি আসিফ শেখ।
আসিফের কথায়, ''আমরা জঙ্গলের বিভিন্ন জায়গায় গা ঢাকা দিয়ে থেকেছি অনেকটা সময়। তারপর ধীরে ধীরে বাঘেদের দেখা পেয়েছি। আমরা জঙ্গলের কোর এরিয়ায় গিয়ে কাজ করেছি। এর জন্য অসম সরকার থেকে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়েছিল। এই কাজে আমাদের খুব সাহায্য করেছেন দিলীপ চৌধুরী, তপন কোচ। তাঁরা জঙ্গলে বাঘেদের গতিবিধি ট্র্যাক করে আমাদের সঠিক জায়গায় গিয়ে কাজ করতে সাহায্য করেছেন। এছাড়া রেঞ্জ অফিসার বরেন বোরো, ডেপুটি ডিরেক্টর টি শশীধর রেড্ডি, ফিল্ড ডিরেক্টর সি রমেশ - সকলে সহযোগিতা না করলে এই শুট করা সম্ভব হতো না। আমরা খুব ভোরে উঠে জঙ্গলে যেতাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্যামোফ্লেজ করে অপেক্ষা করতাম, কখন বাঘ আসবে। দুপুরের দিকটায় একটু বিশ্রাম নিতাম। বিকেলে আবার শুট আর রাতের দিকটায় ফের জঙ্গলে ঢুকে অন্যান্য পশুদের ট্র্যাক করার চেষ্টা চলত। দিন-রাত খুব পরিশ্রম করতে হয়েছে।''
তথ্যচিত্র নির্মাতা আলি আসিফ শেখ।
কিন্তু এত 'লাজুক' বাঘকে যখন সামনে থেকে দেখলেন, ঠিক কী মনে হল? এই প্রশ্নের জবাবে আসিফ নিজের বিস্ময় আর চেপে রাখতে পারেননি। তিনি জানাচ্ছেন, মানসের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের বিশেষত্ব হল তার দীর্ঘদেহী চেহারা এবং উজ্জ্বল চামড়া, লোম। তুলনায় সুন্দরবনের ব্যাঘ্রকুল খানিকটা ম্লান। মানসের একেকটি বাঘ ১৩ থেকে ১৪ ফুট পর্যন্ত দীর্ঘ। তাদের পায়ের ছাপ এত বড় যে এ দেশের বাকি বাঘেদের সঙ্গে তুলনীয় নয়। আসলে অসমের এই জাতীয় উদ্যানের পরিবেশের কারণেই তাদের এত ভালো চেহারা। এখানে অনেক বিস্তৃত জায়গা নিবিড় ঘেরাটোপে বন্দি অর্থাৎ সংরক্ষিত এলাকা। সেখানে যে কোনও প্রাণী খুব ভালোভাবে থাকতে পারে একেবারে নির্বিঘ্নে। এছাড়া মানসে একসঙ্গে এত ধরনের বিরল প্রজাতির প্রাণীর সহাবস্থান ভারতের আর কোথাও নেই।
মানসের বড় রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। ছবি: আলি আসিফ শেখ।
এর আগে আসিফ কাজিরঙা জাতীয় উদ্যানের বাঘদের নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন। টালিগঞ্জের যুবক জানাচ্ছেন, জঙ্গলই তাঁর জীবন। তাই দীর্ঘদিন ধরে ক্যামেরা হাতে জঙ্গল সফর করেন তিনি। এবার তাঁর লক্ষ্য মানসের জঙ্গলকে তুলে ধরা। আসিফ জানিয়েছেন, এবার যাঁরা যেখানে শুট করতে চান, তার জন্য কেন্দ্রের বনমন্ত্রকের অনুমতি দরকার। তা পেলে আগামী বছরের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতেই ফের শুটিংয়ের জন্য মানসের জঙ্গলে যাবেন আসিফ। এই তথ্যচিত্র তৈরির জন্য ২ বছর সময় নিচ্ছেন তিনি। আসিফের এই তথ্যচিত্রের হাত ধরেই মানসের 'লাজুক' বাঘ দর্শন হোক জঙ্গলপ্রেমীদের।
