নির্মল ধর: রোম সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, অধিষ্ঠাতা জুলিয়াস সিজার নির্ভীক, অভিজ্ঞ ও সাহসী সৈনিক ছিলেন সন্দেহাতীতভাবে। কিন্তু দেশের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে কতটা ভালো বা মন্দ ছিলেন, তা নিয়ে তর্ক, দ্বিমত, দ্বিধা, মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন, সিজার ছিলেন ডিক্টেটর, একনায়কতান্ত্রিক শাসক এবং কেউ বলেন, সিজার ছিলেন যুদ্ধবাজ, নিজের সাম্রাজ্য বিস্তারে যথেষ্ট হিংস্র, আপোসহীন, অত্যন্ত ধুরন্ধর কৌশলী। স্বার্থসাধনে কূটকৌশল নিতে দ্বিধাহীন, মগ্নচিত্ত, রীতিমতো নিষ্ঠুর। অথচ এই সিজারই সাধারণ মানুষ ও সৈন্যদের জন্য জমি বিলিয়েছেন, কর রদ করেছেন, আবার নৃশংস হাতে সরিয়ে দিয়েছেন পথের কাঁটা। যিশুর জন্মের একশো বছর আগেই এমন সব কাণ্ড ঘটিয়ে গিয়েছেন রোম সাম্রাজ্যের বিকাশ ও বিস্তার ঘটাতে গিয়ে। সুতরাং, ইতিহাস থেকেই আমরা জানি একনায়কতন্ত্রের উত্থান ও পতনের নানা কাহিনি, যা এখনকার 'গণতান্ত্রিক' পৃথিবীতে গণতন্ত্রের নাম নিয়েই চলছে। চলছে আমাদের দেশেও। বিশ্বের তিন কমিউনিস্ট দেশের প্রধান ভ্লাদিমির পুতিন, জিনপিং ও কিম জং উন তিনজনই আমৃত্যু প্রেসিডেন্ট পদে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন শুধু নয়, পার্টির অভ্যন্তরেও সেই ধারণা প্রোথিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন, বলে শোনা যায়।
গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে দাঁড়িয়েও কোনও কোনও নেতা বিরোধিহীন শাসনতন্ত্র চান অ্যাবসলিউট মেজরিটি নিয়ে পার্লামেন্ট বা বিধানসভায় বসতে। চাইতেন জুলিয়াস সিজারও। আর সেই সিজারের পুরোনো কথাই ফুটে উঠল কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায়। রাসবিহারী শৈলুসিক দলের নতুন প্রযোজনা (৪৪ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ২৯২৪ খ্রিস্টাব্দ) 'সিজার'-এ। না, কমলেশ্বর শুধু পরিচালনা করেননি, শেক্সপিয়ারের রচনাকে ২০২৪ সালের নতুন বয়ানে এক নতুনতর চেহারাও দিয়েছেন। চিরকালীন মহান নাট্যকারের কলমের ওপর এই সময়ের দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ঘটনা ও চরিত্রের উপস্থাপনায় 'সিজার' শুধু আধুনিক হননি, আজকের আদর্শহীন রাজনীতি, ক্ষমতালিপ্সু, দুর্নীতিবাজ, কুচাতুরিপনায় সিদ্ধহস্ত নেতা-শাসকদের সঙ্গে 'সিজার' এর সঙ্গে স্পষ্ট সমান্তরাল রেখা টেনে প্রকৃত অর্থে আজকের রাজনীতিকেই বিদ্ধ করেছেন। মূল রচনার অন্তর্নিহিত বক্তব্যকে কিছুমাত্র ক্ষুন্ন না করেও কমলেশ্বরের কলম রোমে সিজারের হিংস্র ক্ষমতার সামনে সাধারণ মানুষের মূক-বধির হয়ে বেঁচে থাকা কিংবা মৃত্যুর আগে মানুষ শতবার মরে, মরে বেঁচে থাকার সংলাপগুলো সত্যিই আজকের বাস্তবের আয়নায় একাডেমির দর্শকদের ক্ষণিকের জন্য হলেও দাঁড় করিয়ে দেয়। ব্রুটাসের চরিত্রটিকে সিজারের প্রতিদ্বন্দ্বী বা বিপরীত না করে তুলে একজন সাধারণ মানুষের মধ্যেও শিক্ষা, সভ্যতা, চিন্তার দ্বন্দ্বের দোলাচল রেখে তাঁকে গ্রিসের সেনেটরের চেহারার বিপ্রতীপ আদল দিয়ে আজকের একটি বাম দলের দোলাচলের কথাই যেন মনে করিয়ে দেন। নাটকের সমাপ্তি ঘটে অবশ্যই সিজারের হত্যাকাণ্ডে (যা মঞ্চে দেখানো হয় না অবশ্যই) এবং মূল নাটকের মতোই ব্রুটাস ও অ্যান্টনির ভাষণে, যেখানে আভাস থাকে পরবর্তী আরও কিছু ঘটনার।
অপেক্ষাকৃত নতুন দলের এই প্রযোজনা নিশ্চিতভাবেই উপস্থাপনার সৌকর্যে, সৌন্দর্যে, দৃশ্যবৈভবে, নিয়ন্ত্রিত আবহ সঙ্গীতের পরিস্থিতি মাফিক ব্যবহারে, পোশাক ও সাজসজ্জার পরিকল্পনায়, আলোর সুনিপুণ ও পরিস্থিতির প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রিত প্রক্ষেপনে 'সিজার'কে শুধু দর্শনীয় করেই তোলেনি, বলতে পারি এই মুহূর্তের বাংলা নাট্য প্রযোজনায় বলিষ্ঠতার দাবি করতে পারে। টেকনিক্যাল বিভাগের সুবিন্যস্ততার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জুড়ে থাকে প্রায় তিরিশ পয়ত্রিশজন শিল্পীর সমবেত ও ঐকান্তিক জোরাল অভিনয়। দুটি নাম সর্বাগ্রে- সিজারের ভূমিকায় শংকর দেবনাথ ও ব্রুটাসের চরিত্রে অর্ণ মুখোপাধ্যায়। শংকরের চরিত্রায়নে গ্রীক নাটকের উচ্চকিত হাবভাব, তাঁর বাচনেও অতিনাটকীয়তা, চলনে রাজকীয় দম্ভ চরিত্রের 'মোর দ্যান এ হিউম্যান বিয়িং' ব্যাপারটা প্রকাশ করে। আবার দেখা যায় সেই তিনিই প্রজা বা অধীনস্তদের 'জয় জুলিয়াস সিরাজের জয়', 'জয় রোম সাম্রাজ্যের জয়' ধ্বনিতে যেমন আনন্দ বোধ করেন, তেমন দেখনদারি অস্বস্তি বোধ করেন 'জয় গণতন্ত্রের জয়' ধ্বনি না দেওয়ায়।
শংকরের অভিনয় সেই সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনাও প্রকাশ পায়। ব্রুটাস-এর চরিত্রে অর্ণ বেশিরভাগ সময়ে একজন সাধারণ স্বাভাবিক মানুষ, মন আর মগজের দ্বন্দ্বে সে কিছুটা বিক্ষিপ্ত। সিজারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালোবাসা-শ্রদ্ধার পাশাপাশি রাজদ্রোহী হয়ে ওঠার। সেই দ্বন্দ্বের ছটফটানি তাঁর অভিনয়ে স্বাভাবিক ও স্পষ্ট। সিজারের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য সে অনুতপ্ত, আবার মগজ বলে রোমের উত্তরসূরিদের জন্য রাজদ্রোহী হতে, সেই দ্বিধাচিত্তে তাঁর মানসিক সংকটও প্রকাশ পায় কিছু মুহূর্তে তাঁর নিচু লয়ের অভিনয়ে। এই দুজনের পাশে দাঁড়িয়ে সমান তাল-লয়-ছন্দ বজায় রেখে যুথবদ্ধ সুঅভিনয়ের প্রমাণ রেখেছেন পদ্মনাভ দাশগুপ্ত (মার্ক অ্যান্টনি), লোকনাথ দে (ক্যাসিয়াস), অসীম রায়চৌধুরী (কাসকা), গৌতম পুরকায়স্থ (পম্পেই), লিপিকা চট্টোপাধ্যায় (কর্নেলিয়া), অস্মিতা ঘোষ (জুলিয়া),মৌলি রায় (পর্শিয়া), শ্রেয়া সিনহা (চারুবক), নবনীতা দত্ত (ক্যালপুর্নিয়া), পিয়ালি বসু (ক্লিওপেট্রা)।
আর বিভিন্ন কারিগরি বিভাগে শুধু আন্তরিকতা নয়, প্রযোজনাটি সর্বাঙ্গসুন্দর করে তোলায় প্রত্যক্ষ সাহায্য করেছেন প্রেমেন্দু বিকাশ চাকি (আলো), বিশ্বজিৎ (আবহ), গৌতম-শোভন-নারায়ণ-অরূপ (মঞ্চ), মহম্মদ আলি (রূপসজ্জা), শুভদীপ (পোশাক), সৌভিক - দেবমাল্য (অলংকার)। এবং সবশেষে কমলেশ্বরের সামগ্রিক নির্দেশনার প্রশংসার সঙ্গে একটি বাড়তি অভিনন্দন- তিনি মূল নাট্যকার শেক্সপিয়ারকে (অনির্বাণ ভট্টাচার্য) মঞ্চে এনে চারুবাক ও রোমের পেটের তলার বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় বসিয়েছেন। একাধিক দৃশ্যে নাট্যকার বেচারিকে স্পার্টাকাস চরিত্র নিয়ে কোনও কোনও নাটক লেখনি বা আপনি শুধু রাজা, রানী, মহিলা, মন্ত্রী, যুদ্ধ অর্থাৎ রাজকীয় ব্যাপার-স্যাপার নিয়েই মজে ছিলেন, সমাজের নিচুতলার দিকে নজর দেননি- এমন অভিযোগও করানো হয়েছে। যেখানে শেক্সপিয়ারের প্রায় ল্যাজেগোবরে অবস্থা। এজন্য অবশ্যই অনির্বাণের কমিক ঘেঁষা অভিনয় দায়ী। এবং সবশেষে একটাই অনুরোধ, তিন ঘণ্টার নাটকটি কি আড়াই ঘণ্টায় নামিয়ে আনা যায় না? যায়, একটু ভাবুন দলের সব্বাই!