shono
Advertisement
Gargi Roychowdhury as Tarasundari

ক্ষুধিত পাষাণে আজ পুষ্পাঞ্জলি, মঞ্চে তারাসুন্দরীর 'প্রাণপ্রতিষ্ঠায়' গার্গী

গার্গী রায়চৌধুরীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কলম ধরলেন কুণাল ঘোষ।
Published By: Sandipta BhanjaPosted: 01:54 PM Nov 01, 2025Updated: 01:54 PM Nov 01, 2025

কুণাল ঘোষ: আজ পয়লা নভেম্বর শনিবার তারাসুন্দরীরূপে মঞ্চে নামছেন অভিনেত্রী গার্গী রায়চৌধুরি। ইতিহাসের পাতায় উপেক্ষিত এক প্রতিভাকে যেন নতুন করে আবিষ্কারের মাধ্যমে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে চলেছেন আজকের এক শিল্পী। যেহেতু তারাসুন্দরী আমার কাছে এক বিস্ময়মিশ্রিত আকর্ষণীয় চরিত্র এবং যেহেতু গার্গীকে আমি এই সময়ের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী মনে করি, তাই আজ জি ডি বিড়লা সভাঘরের মঞ্চাভিনয়ের সাক্ষী থাকতে যাব এই বিশ্বাস নিয়ে যে আজকের পর বাংলায় আবার আলোচনা, চর্চায় ফিরবেন তারাসুন্দরী।

Advertisement

বঙ্গরঙ্গমঞ্চে যখন কার্যত সামাজিক বিপ্লব করছেন গিরিশ ঘোষ, তখন অন্ধকার জগৎ থেকে আলোয় এসে যে কজন নারীচরিত্র পতিতা থেকে অভিনেত্রী হয়ে উঠেছেন, সেই তালিকার শীর্ষে নটী বিনোদিনী। তাঁকে নিয়ে আলোচনা, সিনেমা, নাটক, সাহিত্যচর্চা হয়েছে বারবার, যুগে যুগে। বিনোদিনীর আলোয় ঢাকা পড়ে থেকেছেন তাঁরই সহযোদ্ধা আরও কয়েকজন। তাঁদের কয়েকজনের নাম অবশ্য বিনোদিনীচর্চার আবর্তে পরিচিত হয়েছে। কিন্তু তাঁরা আলাদা করে আলোচ্য হয়ে ওঠেননি। আমার মতে এই তালিকারই উজ্জ্বলতম নাম তারা, মঞ্চের তারাসুন্দরী। এবং কিছু ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিভা, সাফল্য, যন্ত্রণা, জীবনপথ, দর্শন যেন ছাপিয়ে গিয়েছে স্বয়ং বিনোদিনীকে; তবু, বাঙালি তারাসুন্দরীকে চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখার চেষ্টা করেনি।

বন্দিজীবনে আমি তখন প্রেসিডেন্সি জেলে। 'পূজারিনী' উপন্যাসটি লেখার সময় এই বিষয়টি নিয়ে পড়াশুনোর দরকার পড়ে। জেলের লাইব্রেরির অতি পুরনো অথচ দারুণ প্রবন্ধধর্মী বই, বাইরে থেকে আনানো বিশেষ কিছু তথ্য থেকে বিনোদিনীর আরও বিস্তারিত জানলাম। কিন্তু যেন পরিচয় হল তারাসুন্দরীর সঙ্গে। আমার উপন্যাসটিতে যতটা পেরেছি রেখেছি। পরে আরও সমৃদ্ধ হয়েছি ব্রাত্য বসুর লেখা পড়ে। আমি যেভাবে বুঝেছি তারাসুন্দরীকে, তাঁর চলার পথ ভারি বিচিত্র। তিনি হয়তো বিনোদিনীর থেকেও সুন্দরী, অভিনয়ে আরও ধারালো। একটা সময়ে প্রচার ও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা বিনোদিনী নিজে তারাকে সামনে আনাতে উদ্যোগী ছিলেন। বিনোদিনীর তুফানতোলা চৈতন্যলীলাতে বিনোদিনী নিমাই, তারা সেখানেই বালক নিমাই, শৈশবচরিত্রে। চৈতন্যলীলার পর ফের নিমাই সন্ন্যাসী। গিরিশ ঘোষ থেকে শ্রীরামকৃষ্ণদেব যে আলোকবৃত্ত, বিনোদিনীর সূত্রেই সেখানে তারার যোগাযোগ শুরু। পরে, তারাসুন্দরীর মুঠোয় যখন গ্ল্যামার, বাবুদের চোখ যখন তারার উপর, মঞ্চে তারা সুপারহিট, তখন এই বিনোদিনীই তারাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে আচরণ পাল্টে ফেলেন। তারার উত্থানেই তাঁর অবসান, এমন অস্তিত্বের লড়াই, ধার এবং ভারের ছায়াযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। দুই নারীর তখন এক জটিল সমীকরণ। তারার চন্দ্রশেখর, শৈবলিনী, অযোধ্যার বেগম, আয়েষা, রিজিয়া- পরপর সফল নাটক। তাঁর একচোখে জল, এক চোখে ক্রুরতা, ঠোঁটে হাসি; অসামান্যা অভিনেত্রী তারা।

তারাসুন্দরীর ভূমিকায় অভিনেত্রী গার্গী রায়চৌধুরি।

ইংরেজি পড়তে পারতেন না। স্রেফ শুনে ক্লিয়োপেট্রা, ডেসডিমোনার চরিত্র করতেন, সেই আমেজ আর মেজাজে। নাম, যশ, অর্থ তাঁর মুঠোয়। এসেছে বারবার প্রেম, হাতছানি দিয়েছে। বিয়ে হয়েছিল আরেক নাট্যকর্মী অপরেশ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে, যিনি বিবেকানন্দভক্ত। শিকাগোজয়ের পর কলকাতা ফেরা, ঘোড়ার গাড়ির ঘোড়া খুলে স্বামীজিকে টেনে আনলেন যুবকবৃন্দ, তার মধ্যে থাকা এই অপরেশ সেদিন ভিড়ে চোট পেয়ে শয্যাশায়ীও ছিলেন। তারাসুন্দরীর জীবনে অনেক ভাঙাগড়া। ছেলের অকালমৃত্যুর পর হঠাৎ সব ছেড়ে আধ্যাত্মিকতায় সমর্পণ। নিজের সব অর্জিত অর্থ দিয়েছিলেন আশ্রম গড়তে, ভুবনেশ্বরে। তৈরি করেছিলেন 'রাখালকুঞ্জ'। গিরিশ ঘোষের অনুরোধে আবার মঞ্চে ফেরা। তার পর মৃত্যু। এখানে সবিস্তার লেখার নয়, কিন্তু তারাসুন্দরীর অভিনয়প্রতিভা, কিছুটা লেখালেখি, জীবনদর্শন আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তাঁর 'প্রবাহের রূপান্তর' অবাক হওয়ার মতো। বিনোদিনীর মতো তারাকেও অন্ধকার থেকে আলোয় আসার যুদ্ধ করতে হয়েছে। তিনিও গিরিশবৃত্ত, রামকৃষ্ণদেব, দক্ষিণেশ্বর, বিবেকানন্দ, নাট্যমঞ্চে ঠাকুরের পদার্পণ দর্শনে সমৃদ্ধ, প্রভাবিত। বঙ্গরঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে মহিলা শিল্পীদের শুরুর দিনে নটী বিনোদিনী যদি উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হন; তা হলে তারাসুন্দরীও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য থাকার কথা, অথচ তিনি কার্যত উপেক্ষিতা। পাহাড় ভাঙার গান প্রথম সাফল্যের সঙ্গে বিনোদিনীই গেয়েছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই; তবে সেই আকাশকে বৃহত্তর ব্যাপ্তি দিতে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন তারা।

গার্গী রায়চৌধুরি এই ইতিহাসে উপেক্ষিতাকেই ফেরানোর দায়িত্বপালন করছেন। বিনোদিনীকে নিয়ে একাধিক নাটক, সিনেমা দেখেছি। বিনোদিনীর ভূমিকায় এখনও পর্যন্ত আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে রামকমল মুখোপাধ্যায়ের ছবিতে রুক্মিণী মৈত্রকে। সেটা বড় পর্দায়। এবার মঞ্চে, একক অভিনয়ে তারাকে নিয়ে আসছেন গার্গী। গার্গী দক্ষ অভিনেত্রী; সৌন্দর্য, গ্ল্যামার, আভিজাত্য এবং মেধামিশ্রিত বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থিতির এক সংযমী সংবেদনশীল শিল্পী। তিনি যে তারাসুন্দরীকে তাঁর অভিনয়ের জন্য বেছে নিয়েছেন, সেটাই প্রশংসার। রেডিও, বড় পর্দা, ছোট পর্দা, মঞ্চ, যাত্রা, অভিনয়ের সব মাধ্যমের অভিজ্ঞতার সম্পদ উজাড় করে গার্গী গড়ে তুলছেন তারাসুন্দরীকে। নেপথ্যে অভিভাবকোচিত ভূমিকায় ব্রাত্য বসু। সঙ্গে নাট্যকাঠামো (ব্রাত্যর বই থেকে), সংগীত, পোশাকে উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়, প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক রায়-রা। মঞ্চ সৌমিক-পিয়ালী। নাচের গাইড সুকল্যাণ ভট্টাচার্য। গার্গী পরম যত্ন আর চরম সাধনায় আজ তারাসুন্দরী হয়ে উঠবেন। মহড়াপর্বের যা খবর পেলাম, গার্গী নিজেকে ভেঙেচুরে প্রতিনিয়ত অতীতের পাতার এক অভিমানী নায়িকা হিসাবে নির্মাণ করছেন। আবহ ও গানের প্রয়োগও শুনলাম সময়ের ছোঁয়ামাখা অনবদ্য, অভিনেত্রী গাইছেনও দারুণ। বঙ্গরঙ্গমঞ্চে জীবন উৎসর্গ করা ইতিহাসে উপেক্ষিতা যদি ব্রহ্মাণ্ডের কোনও প্রান্তে থেকে থাকেন ক্ষুধিত পাষাণের বিবর্ণ চেহারায়, আজ তাতে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে আবার প্রাণপ্রতিষ্ঠার পালা। গার্গী, শুভেচ্ছা রইল।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • আজ পয়লা নভেম্বর শনিবার তারাসুন্দরীরূপে মঞ্চে নামছেন অভিনেত্রী গার্গী রায়চৌধুরি।
  • ইতিহাসের পাতায় উপেক্ষিত এক প্রতিভাকে যেন নতুন করে আবিষ্কারের মাধ্যমে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে চলেছেন আজকের এক শিল্পী।
Advertisement