নির্মল ধর: আমরা জানি, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত জনসমাজ চিরটাকালই যে কোনও প্রতিবাদী আন্দোলনের মুখ। সরকারের অপশাসন, দুর্নীতি বা জনবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ঝাণ্ডা হাতে মিছিলে যোগ দেয় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষ। অন্তত এতদিন তো তেমনই হয়ে আসছিল। আজ কিন্তু তাঁদের একটা বড় অংশ মিছিল বিমুখ, প্রতিবাদী কন্ঠস্বর প্রায় স্তব্ধ। শুধু এই রাজ্যে নয়, পুরো দেশজুড়ে ধর্ম নিয়ে মেরুকরণ, প্রশাসনে দুর্নীতির দুর্বৃত্তায়ন, কোনও কোনও রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ মদতে সারা দেশজুড়ে জনগণের কণ্ঠকে রোধ করতে প্রশাসনিক তৎপরতা প্রায় দৈনন্দিন খবর এখন। নৈতিকতার কোনও সার্বিক প্রদর্শনের প্রয়াস এবং সুযোগও নজরে পড়ে না! এটা কি এক ধরনের মানসিক ক্লীবতা ও দেউলিয়াপনা নয়? এখনকার বাংলা নাটকের সংখ্যালঘিষ্ঠ কিছু দর্শক একাডেমি, মধুসূদন, গিরিশ মঞ্চ বা উত্তম মঞ্চে গিয়ে শুধু হাততালি দিয়েই যেন কর্তব্যটি সারেন। আর মঞ্চের বাইরে গিয়ে সুখী সংসারের চৌহদ্দিতে নিরাপত্তাহীন জীবনে নিরাপদে বেঁচেবর্তে থাকার চেষ্টায় মগ্ন! চাকদাহ নাট্যজন দলের নতুন প্রযোজনা 'জগাখিচুরী ২' বাঙালি শিক্ষিত সাধারণ মধ্যবিত্তের সেই ঘুমিয়ে পড়া চেতনাকে জাগিয়ে তোলার প্রয়াস নিয়েছে। যে নাটকের পরিচালনা ও অভিনয়ে বর্ষীয়ান অভিনেতা বহরমপুরের প্রদীপ ভট্টাচার্য।
হিমাদ্রী শেখর দাশের লেখা নাটকটিকে এক কথায় আধুনিক 'প্রহসন' বলাই যায়। সুদূর উত্তরবঙ্গের হাসিমারা অঞ্চলে জাহান্নাম যাত্রা সমাজ নামের একটি ক্ষয়িষ্ণু যাত্রা দলের পুনরায় বেঁচে ওঠার কাহিনীতেই পালাকার বুনে দিয়েছেন আজকের দিনের নানা গল্প নয়, সত্য ঘটনা। রাজনৈতিক দলের নেতাদের আগ্রাসী মনোভাব, দুর্নীতির সঙ্গে নিয়ত আপোস, সাধারণ মানুষকে ভুলিয়ে রাখার কান্ডকারখানা ইত্যকার সাম্প্রতিক নানা ঘট্নাও এসেছে পালাকারের কলমে। দলে যোগ দিয়েছে একসময়ে বিতাড়িত দুই বৃদ্ধ নট অগলা (প্রদীপ) ও বগলা (কমল)। আর আছেন দলের মূল কারিগর পালাকার (সুমন)। এই থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের কলম ও অভিনয়ে গড়ে উঠেছে আজকের সময়ের এক প্রতিবাদী প্রযোজনা। যার শেষে দলের সব্বাই নতুন পালা নিয়ে মাথায় প্রপস নিয়ে গাঁয়ে গঞ্জে ঘুরে ঘুরে নিদ্রিত মানুষের বিবেক জাগিয়ে তুলতে গেয়ে উঠতে চায় চারণকবি মুকুন্দদাশের গান 'ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে,
মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে।। তাথৈ তাথৈ থৈ দ্রিমী দ্রিমী দং দং।। তাথৈ তাথৈ থৈ দ্রিমী দ্রিমী দং দং... ভূত পিশাচ নাচে যোগিনী সঙ্গে...।'
সম্প্রতি নাটকটির প্রথম অভিনয় হয়ে গেল একাডেমির মঞ্চে। প্লাস্টিকের জাল, ছেঁড়া কাপড় ন্যাকড়া দিয়ে 'সাজানো' মঞ্চ, অতি সাধারণ কয়েকটি কাঠের বাক্স, টুল তক্তপোষ, বেশ নিরাভরণ হলেও পরিপাটি মঞ্চসজ্জা। তবে বিয়ের আসরের জন্য মঞ্চে আনা মাইকবক্সগুলো সারাক্ষণ রয়ে গেল কেন? সুরজিৎ নন্দীর আবহ প্রযোজনার নাটকীয় মুহূর্তগুলোর আবেদন পৌঁছে দিয়েছে। তবে সবার আগে দলগত অভিনয়কে এগিয়ে রাখতেই হবে। যদিও তুখোড় নট প্রদীপ ভট্টাচার্য ও কমল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে জমাটি পাল্লা দিয়েছেন জগারুপী সুমন পাল মশাইও। এঁরা তিনজনই নাটকের হাল ধরে রেখেছেন। আর তালে তালে বৈঠা টেনেছেন বাকি কজন- দেবাশিস দে (আলি), অভীক ধর (নিতাই), রিংকু অধিকারী (পূর্ণিমা), বিশ্বজিৎ রায় (মদনা) এবং গায়ক অভিষেক দে (তপন)। শেষ দৃশ্যে 'ভয় কি মরণে...' গানটির সঙ্গে গলা মেলালেন উপস্থিত দর্শকদের একাংশও। প্রযোজনাটির এমন জাদু আকর্ষণীয়।
