অভিরূপ দাস: অধ্যাপক, গায়ক, লেখিকা, চিকিৎসক। সমাজসেবী সংঘের ‘পার্বণী ১৪৩১’-এর নিকানো মঞ্চে আলোচনায় বসেছিলেন চার কৃতী। বাঙালি তো আছে। আর বাঙালিয়ানা? সংবাদ প্রতিদিনের রোববার ডট ইন আয়োজিত রবি সন্ধ্যায় দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত পাড়ায় বিশ্বজিৎ রায়, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, তিলোত্তমা মজুমদার, ডা. কুণাল সরকারের চর্চায় মঞ্চে ঘোরাফেরা করল মায়ের ভাষা।
উত্তাল আলোচনার বাঁকে বাঁকে শব্দ নর্তকী হল। স্রেফ বাঙালিকে নিয়ে শব্দের দেওয়া নেওয়া যে মঞ্চে, তার দুই ধারে পসরা। দেদার বিকোচ্ছে 'গুপি গাইন বাঘা বাইন' টি শার্ট আর রূপম ইসলামের ছবি দেওয়া কাঁধ-ব্যাগ। এই প্রজন্ম কিনছেও হুড়মুড়িয়ে। জেনারেশন জেড নাকি বাংলা ভুলেছে? আলোচনার শুরুতেই যেন এক গোলে এগিয়ে বাঙালিয়ানা।
ছবি: অরিজিৎ সাহা
রবিবারের সাঁঝবেলায় বোকাবাক্স বন্ধ রেখে লেক ভিউ রোডের বাসিন্দারা উজিয়ে এসেছিলেন বাঙালিয়ানার গল্প শুনতে। এ অলৌকিক সন্ধ্যায় আলোচনায় সঞ্চালকের দায়িত্বে সরোজ দরবার। “আমাদের নিয়েই তো আলোচনা। আসুন নিজেদের জন্য একবার হাততালি দিই।”
করতালি শেষে শুরু হল যুক্তি-তর্ক-চর্চার আসর।
[আরও পড়ুন: পাঁচ দশক পর ফিরে দেখা উৎপল দত্তর স্মৃতিমাখা ‘টিনের তলোয়ার’]
শুরুর প্রশ্ন একটাই। “আমি রসগুল্লা ভালোবাসে”,অবাঙালি অভিনেতার আধো আধো উচ্চারণ দেখে আর কতদিন আমোদ খুঁজবে বাঙালি? এমনটা তো ছিল না দুই দশক আগে। টাইম মেশিনে চলে যাওয়া যাক উনিশ শতকে। চারুচন্দ্র দত্তর লেখা থেকে বাঙালিয়ানার যে দর্শন পাওয়া গিয়েছিল, আজ এই দুই হাজার চব্বিশে কতটা বদলে গিয়েছে সেই বাঙালি?
তিলোত্তমা মজুমদার স্বীকার করলেন, বাঙালি বদলেছে। তবে সে তো সময়ের ধর্ম। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও জাতির নিজস্বতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়। উনিশ শতকের বাঙালির সঙ্গে আজকের বাঙালির বৈশিষ্ট্যর পরিবর্তন হয়েছে। তবে তাদের কাছে আমরা ঋণী।” ঋণী চিকিৎসক কুণাল সরকারও। কিন্তু বাংলা বাঙালিয়ানা নিয়ে হতাশ। তারই গল্প শোনালেন ডাক্তারবাবু। জিপিওর পাশের বাড়িটা এখন কয়লার দোকান। আগে ছিল পানের দোকান। কুণাল সরকারের আক্ষেপ, ‘‘একদিন ওই বাড়িটা থেকে সিঙ্গাপুরকে শাসন করা হত!’’ এখন বাঙালির যে কৃতিত্ব তাকে নেহাতই ব্যক্তিকেন্দ্রিক হিসাবে দেখছেন চিকিৎসক। তাও আবার স্বার্থসিদ্ধির জন্য।
চিকিৎসকের কথায়, একেকজন গিয়ে রাজ্যসভায় বসছেন, একজন অ্যাকাডেমির মাথা হচ্ছেন। কিন্তু শিরদাঁড়া উঁচু করে কোনও প্রশ্ন করছেন না, আগামীর ভবিষ্যৎ কী?’’ এত কিছু না পাওয়ার গল্প শুনতে নারাজ অধ্যাপক বিশ্বজিৎ রায়। বরং তিনি মনে করেন এই হাহাকার শুধু ভদ্রলোক মধ্যবিত্তর। ৩৬ জাতের রক্ত মিশে আছে বাঙালির রক্তে। বিশ্বজিতের কথায়, ‘‘বাঙালির অর্থনৈতিক রাজনৈতিক দেউলিপনার যুগে বাঙালিয়ানা নিয়ে সন্দিহান ভদ্রলোক মধ্যবিত্তরা। তারাই এই প্রশ্ন তোলেন। নিম্নবর্গীয়দের মধ্যে এহেন হাহাকার নেই। তারা এখনও ইতিবাচক ভাবছেন।’’ বাংলা মাধ্যম স্কুল কমছে। অধ্যাপক মনে করছেন, সেটাই বাঙালিয়ানার অর্ন্তজলি যাত্রার শুরু।
তবে খেলা এখানেই শেষ মানতে নারাজ তিনি। চাকা ঘুরবে। বাঙালিয়ানাকে সুস্থিতি দিতে বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয় ব্যবস্থার কাছে ফিরতেই হবে। কিন্তু ফিরছে না তো কেউ। উচ্চমাধ্যমিক, জয়েন্ট এন্ট্রান্সে যাঁরাই মেধা-তালিকায় পাড়ি দিচ্ছেন বিলেতে। কেউ নিউ জার্সি, কেউ সান ফ্রান্সিসকো। গায়ক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, একথা সবাই জানে বাংলার অর্থনীতি চাঙ্গা হবে ইন্ডাস্ট্রি এলে। কিন্তু কেউ আসে না। সবাই চলে যায়। তা সে আমেরিকা হোক বা মঙ্গলগ্রহ বাড়ছে কিন্তু বাঙালিই। সেখানেই গিয়ে বাঙালিরা বাঙালিয়ানার আধিপত্য বিস্তার করছে।
বছর বছর বিলেতে গানের অনুষ্ঠান করতে যান অনিন্দ্য। ‘‘এক বছর আগে গিয়ে শুনেছিলাম নিউ জার্সিতে ৪৭টা দুর্গাপুজো করছে বাঙালিরা। গতবছর গিয়ে শুনলাম সেটা এখন ৬৭! তা হলেই বুঝুন। বিদেশেও বাঙালি কোষ বিভাজন করে বেড়ে চলেছে।’’ অনিন্দ্যর কথায়, ‘‘ওরা হয়তো ডলার-পাউন্ড পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মতোই ছড়াচ্ছে। আফটার অল বাঙালি তো! নিউ জার্সিতে যদি একটা সমাজসেবী সংঘ থাকে। সেটা এরকমই।’’