কৃশানু মজুমদার ও মণিশংকর চৌধুরী: মোরগের ডাকে নয় বরং বন্দুক, কামানের গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভাঙত তাঁর। চোখের সামনে সেই ছেলেবেলায় দেখেছেন তালিবানি শাসনের বর্বরতা। তাঁর দুঃস্বপ্নে এখনও ভেসে ওঠে কাবুলের ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে সাধারণ মানুষের গণহত্যার ছবি। তখন মাটির সঙ্গে কথা বলছেন জোহিব আমিরি। সেই কোন ছেলেবেলায় দেশ ছেড়েছিলেন। স্বপ্ন দেখেছিলেন, শান্তির বাতাস বইবে হিন্দুকুশ ঘেরা দেশে। ভয়, সন্ত্রাস শব্দগুলো অভিধানের পাতাতেই কেবল লেখা হয়ে থাকবে। আমিরির স্বপ্ন সফল হয়নি। আদৌ কি হবে? কেউ জানেন না। আমিরিও তা জানেন না। সুদূর কানাডার মন্ট্রিয়ালে বসে দেশের মানুষের জন্য চোখের জল ফেলছেন তিনি। ‘সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল’-কে আফগানিস্তান ফুটবলের অন্যতম স্তম্ভ বলছেন, “আমার দেশ এবং দেশের মানুষ খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এটা অত্যন্ত পীড়াদায়ক। বিশ্বাস করুন, খুবই মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি।”
দেশ থেকে অনেক দূরে থাকলেও কল্পচোখে আমিরি দেখছেন কাবুলের ধুলো ওড়া রাস্তায় ফুটবল খেলে বেড়াচ্ছে একটা ছেলে। খুঁজছেন নিজের ছেলেবেলা। খুঁজছেন তাঁর বন্ধুদের। আমিরির মতো ভাগ্য অবশ্য সবার নয়। তিনি দেশ ছাড়লেও তাঁর মতো অনেকেই থেকে যান আফগান-মুলুকে। ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার তাঁরা। সামনের বদলে পিছনে হেঁটে যাওয়া দেশটির অকাশবাতাস ভারী হয়ে থাকে কান্নার শব্দে। সেখানে বারুদের গন্ধ।
[আরও পড়ুন: Taliban capture Afghanistan: কাবুল ছাড়ার মরিয়া চেষ্টা, বিমানবন্দরে জনসমুদ্র, মৃত ৫]
মার্কিন সেনার তাড়া খেয়ে প্রায় দুই দশক আগে কাবুল থেকে পালিয়েছিল তালিবান। আফগানরা বুক ভরে নিশ্বাস নিয়েছিলেন। বোরখার আড়ালে প্রাণ খুলে হেসেছিলেন আফগান সুন্দরীরা। কিন্তু চলতি বছর আমেরিকা সরে যেতেই গণতন্ত্র সেখানে ভূলুণ্ঠিত। বাঁধভাঙা জলের মতো কাবুলে ঢুকে পড়ে তালিবান জঙ্গিরা। দখল করে নেয় রাজধানী। শহরের একমাত্র সুরক্ষিত বিমানবন্দর থেকে নাগরিকদের সরিয়ে নিতে বারবার ওঠানামা করছে মার্কিন বিমান। অবরুদ্ধ শহরের রাস্তায় দিশেহারা হয়ে পথ খুঁজছে হাজার হাজার মানুষ। দেশের রাজপথে দেখা যাচ্ছে অভূতপূর্ব দৃশ্য। গাড়ির ইঞ্জিন চালিয়ে রেখে দরজা খুলে মার্কিন বিমানে ওঠার জন্য দৌড় লাগাচ্ছে ভয়ার্ত মানুষ। তালিবান শাসকদের দৌলতে বদলে গিয়েছে দেশের নামও। দেশটির নতুন নাম এখন ‘ইসলামিক এমিরেট অফ আফগানিস্তান’।
আমিরি অবশ্য দেশ ছাড়েন অনেক আগে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৮। ওই সময়ই দেশে থাবা বসিয়েছে তালিবান। সেই ভয়াবহ সময়ের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে আফগানিস্তানের প্রাক্তন অধিনায়ক বলছেন, “তালিবানরা যখন প্রথম ক্ষমতা দখল করল, সেই দুঃসহ স্মৃতি আমার এখনও বেশ মনে আছে। ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকত দেশের মানুষজন। চোখের সামনেই দেখেছি তা। সব কিছু বোঝার মতো বয়স তখন আমার ছিল না। অনেকেই আশা করেছিলেন এরকম দিন যেন আর ফিরে না আসে। কতটা ভয়ঙ্কর ছিল সেই সব দিন, তা বর্ণনা করতে পারব না। সেই সব দিনগুলোর কথা মনে করলে এখনও আমার বুক কেঁপে ওঠে।”
আফগান-ভূমে পট পরিবর্তন নতুন কোনও ঘটনা নয়। ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে ১৯৯০ সালে জন্ম হয় আমিরির। তার ঠিক এক বছর আগে মুজাহিদদের সঙ্গে লড়াইয়ে ক্লান্ত সোভিয়েত বাহিনী ফিরে গিয়েছে দেশে। আফগান কমিউনিস্টদের পতনে স্তিমিত ‘লালঝড়’। তার দু’বছর বাদেই কাবুলের দখল নেয় মুজাহিদরা। বাধ্য হয়ে ইস্তফা দেন সোভিয়েতপন্থী আফগান প্রেসিডেন্ট মহম্মদ নাজিবুল্লা। সময় যত এগোতে থাকে মুজাহিদদের দুর্নীতি ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে আমজনতা।
তখনই ইসলামের পথে মুক্তির আশ্বাস দিয়ে জনমানসে প্রতিষ্ঠা পায় তালিবান। নেতৃত্বে মোল্লা ওমর। এই সংগঠনটি ক্রমে কোণঠাসা করে ফেলে মুজাহিদ ও স্থানীয় মিলিশিয়াগুলিকে। ১৯৯৬ সালে কাবুল দখল করে তালিবান। প্রকাশ্যে রাস্তায় নাজিবুল্লাকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেয় তারা। তারপর এক অন্ধকার যুগ শুরু হয় সেই দেশে। আফগানিস্তানে সংখ্যালঘু হিন্দু, শিখদের ধর্মান্তরিত করার জন্য তেড়েফুড়ে ওঠে ‘আল্লার সৈনিকরা’। সুন্নি জঙ্গিগোষ্ঠীটির কাছে অস্পৃশ্য মুসলিম হাজারা সম্প্রদায়ের জীবনে নেমে আসে অশেষ দুর্দিন। সেই হাজারা পরিবারেই জন্ম হয় আমিরির। তারপরের ঘটনা ইতিহাস। রক্তমাখা পথ অতিক্রম করে ফুটবলের সবুজ ময়দানে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ার এক অনবদ্য লড়াইয়ের গল্প।
আমিরি দেশ ছেড়ে প্রাণে বেঁচেছেন।কিন্তু সবার ভাগ্য তো আবার আমিরির মতো নয়। আজ অর্থাৎ সোমবার কাবুল বিমানবন্দরের পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ তা দেখে ফেলেছে গোটা বিশ্ব। দেশের সমস্ত বর্ডার ক্রসিং পয়েন্ট দখল করে নিয়েছে তালিবান। আর তার ফলে সড়কপথে পাকিস্তান বা তাজিকিস্তানে পালানোর কোনও উপায় নেই। আফগানিস্তান থেকে বের হওয়ার একমাত্র পথ কাবুল বিমানবন্দর। আর সেখানেই মার্কিন বায়ুসেনার বিমানে করে দেশত্যাগীদের ছবি চোখে জল আনার মতো। বিমানে জায়গা নেই। অনেকে আবার চাকার উপরে বসে পালানোর চেষ্টায় মাঝ আকাশ থেকে ছিটকে নীচে পড়ে প্রাণ দিয়েছেন। আর যারা বিমানে জায়গা পাননি তাদের নিয়তি কী, তা কেউ জানে না। শোনা যাচ্ছে, ইসলামিক আফগানিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করা হয়েছে তালিবান নেতা আবদুল ঘানি বারাদারকে। তবে তালিবানের সরকারকে স্বীকৃতি দেবে না বলে আপাতত জানিয়ে দিয়েছে ব্রিটেন, রাশিয়া ও আমেরিকা। কার্যত তালিবান শাসনকে মান্যতা দিয়েছে চিন। নাটের গুরু যে পাকিস্তান তা বলাই বাহুল্য। আর এই মারপ্যাঁচে পড়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত আম আফগানদের।
আমিরির পরিবারের কেউ অবশ্য এখন আর আফগানিস্তানে থাকেন না। তবে তাঁর অনেক বন্ধু এখনও সে দেশে রয়ে গিয়েছেন। আমিরি বলছেন, “আমার পরিবারের সদস্যরা কেউ না থাকলেও আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখি। ওদের সঙ্গে আমার প্রায়ই কথা হয়। ওদের দুঃখদুর্দশার কথা শুনলে খুব খারাপ লাগে। আমার পরিবারের কেউ এখন আর আফগানিস্তানে হয়তো নেই। তবে দেশের প্রত্যেকে আমার বর্ধিত পরিবারের সদস্য।”
আমিরি যাঁদের পরিবারের সদস্য বলছেন, তাঁদের এখন কী অবস্থা? উত্তরটা খুব একটা সুখকর নয়। কাবুল, জালালাবাদ, কান্দাহার, মাজার-ই-শরিফে ফের গজিয়ে উঠেছে বোরখার দোকান। ইসলামের নামে শরীর ঢাকার হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছে। কারণ তালিবান রাজত্বে পান থেকে চুন খসলেই গর্দান যাবে। কাবুলিওয়ালার দেশের আকাশে আর উড়বে না ঘুড়ি। কারণ, তালিবানের মতে, ঘুড়ি ওড়ানো হারাম। বাড়ির বাইরে পুরুষ সঙ্গী ছাড়া (বাবা, বর অথবা ভাই) বের হতে পারবেন না মহিলারা। মেয়েদের জন্য বন্ধ স্কুলের রাস্তা। একধাক্কায় অনেকটাই পিছিয়ে গিয়েছে আফগানিস্তান।
এদিকে, আফগানিস্তানের সার্বিক পরিস্থিতি ভাবাচ্ছে ভারতকেও।বন্ধু দেশটি তালিবনের দখলে চলে যাওয়ায় পূর্ব-এশিয়ায় ধাক্কা খেয়েছে নয়াদিল্লি। গত কুড়ি বছরে আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশে ভারত চারশোরও বেশি প্রকল্প তৈরি করেছে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ দেড় বিলিয়ন ডলার। সালমা বাঁধের মতো ভারতীয় প্রকল্প নষ্ট করবে না বলে মৌখিক আশ্বাস দিয়েছে তালিবান। কিন্তু ভারত নিশ্চিত নয়। দ্বিতীয় দুশ্চিন্তা অবশ্যই কাশ্মীর। আফগানিস্তানে পাক আধিপত্য বাড়লে কাশ্মীর নতুন শিরঃপীড়ার কারণ হতে পারে। কিন্তু পূর্ণ ক্ষমতা পাওয়ার পর পাকিস্তানের মদতে যুদ্ধপ্রেমী আফগান গোষ্ঠীপতিরা কাশ্মীরের জইশ ও লস্কর জঙ্গিদের যে উসকানি দেবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? অবশ্য সেটা এখন সময়ের গর্ভে।
ভারতীয় ফুটবলে বেশ পরিচিত মুখ আমিরি।মুম্বই এফসি, ডেম্পো, এফসি গোয়া, ডিএসকে শিবাজিয়ান্স, গোকুলম, রিয়াল কাশ্মীরের মতো ক্লাবে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। আফগানিস্তানের জার্সি পরে সুনীল ছেত্রীদের বিরুদ্ধেও খেলেছেন আমিরি। দেশের উঠতি ফুটবলারদের কাছে তিনি আদর্শ। সেই আমিরি দেশের খারাপ সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশকে পাশে চাইছেন। আমিরি বলছেন, “ভারত-সহ সমস্ত দেশের উচিত আফগানিস্তানের পাশে এসে দাঁড়ানোর। এটাই সেরা সময়।”
আফগানিস্তানের এই খারাপ সময়ে তারকা ক্রিকেটার রশিদ খান নিজের বক্তব্য পেশ করেছেন। গত মঙ্গলবার এক টুইটবার্তায় আফগানিস্তানের এই স্পিনার লেখেন, “আমার দেশ বিশৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে। আফগানদের হত্যা ও আফগানিস্তানকে ধ্বংস করা বন্ধ করুন।”
রশিদের সুরে সুর মিলিয়ে আমিরি বলছেন, “প্লেয়ার হিসেবে আমাদের বড়সড় ভূমিকা রয়েছে। দেশের মানুষের পাশে এখন থাকা উচিত সবার। অনেক মানুষ বাড়ি ঘর হারিয়ে ফেলেছেন। আমাদের মতো প্লেয়ারদের এখন সেই সমস্ত মানুষদের সাহায্য করাই দরকার।”
সুদিন ফেরার আশায় আমিরি। কিন্তু কবে ‘বসন্তের বাতাস’ বইবে সে দেশে? এখন সে দেশে একটাই নীতি। তা হল, জোর যার মুলুক তার। রাষ্ট্রসংঘ কার্যত নখদন্তবিহীন বাঘে পর্যবসিত হয়েছে। বন্দুকের নলই যে আফগান-মুলুকে ক্ষমতার আসল উৎস, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।