অমিত সিং দেও, মানবাজার: শ্লথ বিয়ারের সঙ্গে সহাবস্থান হানি ব্যাজারের! বনদপ্তরের পাতা ট্র্যাপ ক্যামেরায় এমনই ছবি ধরা পড়ল পুরুলিয়ায়। যার ফলে খুশির জোয়ার পুরুলিয়া বনবিভাগে। বনকর্তাদের দাবি, এ রাজ্যে এই প্রথম এই বিরল স্তন্যপায়ী প্রাণীর অস্তিত্ব ধরা পড়ল। যার জেরে হানি ব্যাজারকে নিয়ে গবেষণা আরও এগোবে বলে আশাবাদী বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞরা।
বনদপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, পুরুলিয়ার বনাঞ্চলে দুটি পৃথক ক্যামেরায় তিনটি হানি ব্যাজারের ছবি ধরা পড়েছে। যার মধ্যে একটি মাদি। তাও আবার গর্ভবতী, মধ্যবয়স্ক। কেমন এই হানি ব্যাজার প্রাণীটি, একনজরে দেখে নেওয়া যাক -
১. বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ শ্রেণির সিডিউল ১-এর অন্তর্গত এই স্তন্যপায়ী নিশাচর প্রাণীটি সর্বভূক
২.খাদ্য তালিকায় রয়েছে মধু, লার্ভা, জঙ্গলের কন্দ, মূল। সেই কারণে এর নাম হয়েছে Honey (মধু) Badger. এছাড়া তারা কচ্ছপ, সাপ, ডিমও খায়
৩.উচ্চতা ৯ থেকে ১৩ ইঞ্চি পর্যন্ত
৪.ওজন প্রায় ৬ থেকে ১৪ কেজি পর্যন্ত
৫.জঙ্গলে এদের গড় আয়ু ৭ থেকে ৮ বছর, তবে পোষ্য হলে ২৬ বছর পর্যন্ত আয়ু তালিকাভুক্ত করা হয়েছে
৬.তীক্ষ্ম লম্বা নখ, লেপার্ড-সিংহের সঙ্গে লড়াইয়ে পারদর্শী
৭.মূলত এরা আফ্রিকা, এশিয়া মহাদেশের জঙ্গলের বাসিন্দা, ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে দেখা যায়
৮.পাথুরে গুহা বা মাটিতেও গর্ত খুঁড়ে বাসা বাঁধে
৯.দিনেরবেলা নিজেদের গুটিয়ে রাখে, রাতের অন্ধকারেই গতিবিধি বাড়ে
তবে এই রাজ্যে হানি ব্যাজার নামক বন্যপ্রাণীর অস্তিত্বের ছবি-সহ এই প্রথম প্রমাণ মিলেছে বলে দাবি বনদপ্তরের। পুরুলিয়ায় বন্যপ্রাণ নিয়ে কাজ করা সংগঠন ওয়াইল্ড লাইফ অ্যান্ড ইকোলজির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শ্বেতাদ্রি ভাণ্ডারি বলেন, "বিভিন্ন বন্যপ্রাণের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য বনদপ্তরের সঙ্গে যৌথ ভাবে কোটশিলার সিমনির জঙ্গলে কয়েকটি ট্র্যাপ ক্যামেরা বসানো হয়েছিল। আমরা ভাবতেও পারিনি যে সেখানে বিরল এই বন্যপ্রাণীর ছবি ধরা পড়বে!"
বনদপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, অযোধ্যা পাহাড়ের গোবরিয়াতে ২০১৯ সালে কিছু পায়ের ছাপ পাওয়া যায়। সেই থেকে বনদপ্তর প্রাথমিক অনুমান করে যে পুরুলিয়ার জঙ্গলে হানি ব্যাজারের উপস্থিতি রয়েছে। তবে ওই সময় একেবারে নিশ্চিত হতে পারেননি বনকর্তারা। তবে সম্প্রতি পুরুলিয়া বন বিভাগের কোটশিলা বনাঞ্চলের সিমনি বিট এলাকায় লেপার্ডদের একাধিক মুহূর্তের ছবি ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্লথ বিয়ার, বার্কিং ডিয়ার, গন্ধগোকুলের মতো বন্যপ্রাণের ছবি ধরা পড়ে। ঝাড়খণ্ড ঘেঁষা এই সিমনি এলাকার জঙ্গল যে একাধিক বন্যপ্রাণের থাকার আদর্শস্থল, তা নিশ্চিত হয়ে যায় বনদপ্তর। তার পর সম্প্রতি বনদপ্তরের ওয়াইল্ড লাইফ উইংস থেকে পুরুলিয়ার সমস্ত বনাঞ্চলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বন্যপ্রাণের হদিশ পেতে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ওই তথ্য সামনে আসার পর বনদপ্তর পুরুলিয়ার জঙ্গলে থাকা লেপার্ড, ডোরাকাটা হায়না, ভারতীয় ধূসর নেকড়ে-সহ নীল গাইয়ের উপস্থিতি জানতে পারে।
চলতি বছর এপ্রিল মাসে জঙ্গল লাগোয়া কয়েকটি জলাশয়ের পাশে বেশ কিছু ক্যামেরা বসানো হয়। আর ওই ক্যামেরাতেই একই স্থানে শ্লথ বিয়ারের পাশাপাশি হানি ব্যাজারের ছবি ধরা পড়ে। সম্প্রতি এই বন্যপ্রাণের ছবি-সহ তথ্য সম্বলিত একটি লেখা প্রকাশ হয় 'ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ ফাউনা এন্ড বায়োলজিক্যাল স্টাডি'তে। শ্বেতাদ্রিবাবুর কথায়, "বিগত বেশ কিছু বছর ধরে দেখা যায়, অনেক বন্যপ্রাণকেই পুরুলিয়ায় প্রথমবারের জন্য ক্যামেরা বন্দি করা গিয়েছে। বার বার এটা প্রমাণিত হচ্ছে শে পুরুলিয়ার জঙ্গল বাস্তুতন্ত্রের নিরিখে কতটা ভালো। আমরা ঠিক যে ক্যামেরাতে এই হানি ব্যাজার পেয়েছি, সেই একই স্থানে শ্লথ বিয়ারও পেয়েছি। বর্তমানে আমরা এই অঞ্চলে আরও কাজ চালাচ্ছি যাতে এই বন্যাপ্রাণ এই জঙ্গলকে ঠিক কীভাবে ব্যবহার করছে। এদেরকে এই অঞ্চলে সংরক্ষণ করতে হলে কী কী আরও কাজ করা যেতে পারে, সেগুলি বুঝতে পারি।"