সৌরভ মাজি, বর্ধমান: বর্ধমান শহর সংলগ্ন খাগড়াগড় মাঠপাড়া বাদশাহী রোডের সেই জঙ্গি ডেরার কাছে বাড়ি ভাড়া নিয়ে ছাপানো হত নকল ৫০০ টাকার নোট। তারপর তা ছড়িয়ে দেওয়া হত শহর সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায়। বৃহস্পতিবার দুপুরে সেখানে হানা দিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করল পুলিশ। ধৃতদের কাছ থেকে উদ্ধার করেছে কয়েকহাজার টাকার জাল নোট। জাল নোট তৈরির মেশিন, ডাইস, রঙ, পাউডার, রাসায়নিক পদার্থ, নোট ছাপানোর কাগজও বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ।
পূর্ব বর্ধমানের পুলিশ সুপার কামনাশিস সেন বলেন, “সপ্তাহ খানেক ধরে আমাদের কাছে খবর আসছিল বিভিন্ন জায়গায় জাল নোট ছড়ানো হচ্ছে। তারপর থেকেই তদন্ত শুরু হয়। কোথা থেকে আসছে সেই নোট তারও সন্ধান মেলে। এদিন অভিযান চালিয়ে চক্রের তিনজনকে ধরা হয়েছে। এই চক্রে আরও অনেকে জড়িত থাকতে পারে। তাদের সন্ধান পেতে ধৃত তিনজনকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”
পুলিশ জানিয়েছে, ধৃতরা হল উত্তর ২৪ পরগনার বাগদা থানার পাথুরিয়া কলোনির দীপঙ্কর চক্রবর্তী, পূর্ব বর্ধমানের শক্তিগড় থানার বড়শুলের বামুনপুকুর পাড়ার বিপুল সরকার ও বর্ধমান শহরের লোকোমোড় কালীতলা এলাকার গোপাল সিং। এর মধ্যে দীপঙ্কর এই চক্রের মূল পাণ্ডা বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে পুলিশ। দীপঙ্করই জালনোট ছাপানোর কাগজ নিয়ে আসতো এই ডেরায়। আজ, শুক্রবার ধৃতদের বর্ধমান আদালতে পেশ করবে পুলিশ।
[আরও পড়ুন: ফেসবুকে ভুয়ো পরিচয়ে যুবতীর সঙ্গে প্রেম, নগ্ন ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি, গ্রেপ্তার রাঁধুনি]
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, কয়েকমাস আগে খাগড়াগড় মাঠাপাড়া এলাকায় শেখ সিরাজুল ইসলামের বাড়িতে ঘরভাড়া নেয় গোপাল সিং। মা ও অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে থাকতো গোপাল। সে লাইসেন্স, পরিচয়পত্র তৈরির কাজ করে বলে এলাকার লোকজন জানতেন। মাঝে মাঝে তার কাছে বাইরে থেকে লোকজন আসতো। আবার চলেও যেতো। কিন্তু ওই ভাড়া বাড়িতেই যে জালনোট তৈরি করা হত তা স্থানীয়রা বুঝতেই পারেননি। পুলিশ সুপার জানান, সপ্তাহখানেক ধরে তাঁদের কাছে খবর আসছিল বিভিন্ন বাজার এলাকায় জালনোটের কারবার চলছে। প্রচুর পরিমাণ মালপত্র কিনে জালনোট দেওয়া হচ্ছিল। সেই সূত্র ধরে তদন্তে নামে পুলিশ। হদিশ পায় জালনোট তৈরির কারখানার। এই তিনজনের কারবারের কথা জানতে পারে। বুধবার রাত থেকেই সিরাজুলের বাড়িটির উপর নজরদারি শুরু করে পুলিশ। এদিন দুপুরে এই তিনজনই যখন বাড়িতে ঢোকে তখন হানা দেয় পুলিশ। হাতেনাতে তিনজনকে ধরে। উদ্ধার করা হয় জালনোট তৈরির সামগ্রীও।
পুলিশ তদন্তে জানতে পেরেছে, এই বাড়িতে জালনোট তৈরির পর বিভিন্নজনের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেওয়া হত বাজারে। এক হাজার টাকার আসল নোটের বিনিময়ে তারা তিন হাজার টাকার জালনোট দিত। বর্ধমান শহর ও সংলগ্ন এলাকার পাইকারি বাজার, সবজি বাজার, মাছের বাজার, পেট্রোল পাম্প, চালের আড়ৎ-সহ বিভিন্ন জায়গায় সেই জালনোট দিয়ে কেনাবেচা চলছিল। বিক্রেতারা অনেক সময় তাড়াহুড়োয় ৫০০ টাকার নোট যাচাই করে নিতে পারতেন না। এইভাবে প্রায় ৬ মাস ধরে এরা এখানে কারবার চালাচ্ছিল। এই চক্রে আরও অনেকে জড়িত বলে মনে করছে পুলিশ। তাদের সন্ধান শুরু করেছে। একই সঙ্গে এই চক্রের জাল কতদূর বিস্তৃত তা তদন্তে প্রকাশ পাবে বলে জানান এক পুলিশকর্তা।
[আরও পড়ুন: পরীক্ষা না দিয়েই কল্যাণী এইমসে চাকরি! এবার নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে নাম দুই বিজেপি বিধায়কের]
যে বাড়িতে এদিন জালনোট তৈরির কারখানার হদিশ মিলেছে সেখান থেকে কয়েকশো মিটার দূরেই ছিল সেই বিখ্যাত ‘জঙ্গি ডেরা’। ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর খাগড়াগড়ে জঙ্গিদের ভাড়া নেওয়া বাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটেছিল। দেশজুড়ে তোলপাড় হয়েছিল সেই ঘটনায়। জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) সেই ঘটনার তদন্ত করে। তদন্তে জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) জঙ্গিরা এখানে কার্যকলাপ চালাতো বলে জানতে পারে এনআইএ। তার পর বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেফতার হয় বেশকয়েকজন জঙ্গি। আদালতে অনেকের শাস্তিও হয়েছে। কয়েকজন অবশ্য এখনও ফেরার। সেই জঙ্গি ঘাঁটির অদূরেই এবার জালনোট কারখানার হদিশ মিললো। কয়েকমাস আগে বর্ধমান শহরে হদিশ মিলেছিল হেরোইন তৈরির কারখানারও।