বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: আর কতটা সর্বনাশের পর খরা ঘোষণা হবে? অনাবৃষ্টিতে বিধ্বস্ত উত্তরের চা এবং কৃষি বলয়ে ঘুরছে এই একটাই প্রশ্ন। বিঘার পর বিঘা জমির সবজি, পাট তাপদাহে পুড়ে খাক হয়েছে। চা বলয়ে ফার্স্ট ফ্ল্যাশে পাতা মেলেনি। সেকেন্ড ফ্ল্যাশে গাছ শুকিয়ে মরছে। জলস্তর ক্রমশ নামছে। বেশিরভাগ জায়গায় একশো ফুট গভীর থেকেও স্যালোতে সেচের জল মিলছে না। চা বাগানে কোথাও সপ্তাহে তিনদিন। আবার কোথাও একদিন কাজ চলছে। লোকসানের ধাক্কায় দিশাহারা চাষিদের বড় অংশ চা বাগানের জমি বিক্রির জন্য মরিয়া চেষ্টা শুরু করেছেন। সেখানে পা রাখতে চা চাষিদের কাতর আবেদন শুনতে হচ্ছে, বাগানের সবুজের বংশ নেই। গাছ শুকিয়ে মরে শেষ। এখন খরা পরিস্থিতি ঘোষণা হলে কিছু সরকারি সাহায্য মিলত। অনেকেই ধারদেনার হাত থেকে রেহাই পেতেন। পাট ও সবজি চাষিরাও একই কথা বলছেন। যদিও কৃষি কর্তারা উদ্বেগজনক অবস্থা নিয়ে মুখ খুলছেন না। তাদের একই কথা, পরিস্থিতির দিকে নজর রাখা হয়েছে।
এদিকে কৃষকরা দিশাহারা। কেন এমন দশা হবে না? জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি ব্লকের মাধবডাঙা গ্রামের যেদিকে চোখ যায় ধূধূ মাঠ। ধূলো উড়ছে। হঠাৎ সেখানে পৌঁছে কেউ বুঝতে পারবে না এসবই পাট ও সবজি খেত ছিল। ছিটেফোঁটা সবুজ নেই। তাপদাহের এতোটাই দাপট যে খেতে মনে হবে কেউ যেন আগুন দিয়েছে। স্থানীয় কৃষক গৌরাঙ্গ শর্মা, বিশ্বনাথ রায় জানান, অনেকেই সেচের জল কিনে ফসল রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। এখন স্যালোতেও জল উঠছে না। তাই তারা হাল ছেড়ে বৃষ্টির আশায় বসে আছেন। ওই গ্রাম জুড়ে বেড়ে ওঠা চা বাগানের পরিস্থিতি আরও শোচনীয়। চা গাছ বোঝার উপায় নেই। শুকনো ঝোপঝাড় ভেবে ভুল হতেই পারে। পানবাড়ি গ্রামের চা চাষি মানিক মজুমদার জানান, তার দুই একর এলাকার চা বাগান শুকিয়ে শেষ হয়েছে। তিনি বলেন, "ফার্স্ট ফ্ল্যাশে পাতা মেলেনি। সেকেন্ড ফ্ল্যাশের সময় গাছ শুকিয়ে মরল। কেমন করে ধারদেনা মেটাবো জানি না। চেষ্টা করছি চা বাগানের জমি বিক্রি করে যদি কিছু টাকা পাই।"
শুধু মানিকবাবু কেন? উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুর থেকে কোচবিহারের মেখলিগঞ্জ পর্যন্ত একই ছবি। লোকসানে নিয়মিত চা বাগান পরিচর্যার কাজ ছেড়ে দিয়েছেন অনেকে। কিছু চা চাষি সপ্তাহে তিনদিন কাজ করাচ্ছেন। জলপাইগুড়ি জেলা ক্ষুদ্র চা চাষি সংগঠনের অন্যতম কর্তা রজত কার্জি জানান, ওই কারণে গ্রামে বেকারি বেড়েছে। খরা ঘোষণা হলেও কিছু সরকারি সাহায্য পেয়ে অনেকে চা বাগান টিকিয়ে রাখার পথ খুঁজত। সেই সুযোগও নেই। তাই বেশিরভাগ চাষি হাল ছেড়ে দিয়েছেন। ওই পরিস্থিতিতে রীতিমতো উদ্বিগ্ন কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান স্মল টি গ্রোয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বিজয়গোপাল চক্রবর্তী জানান, এভাবে লোকসানে ডুবে চা বাগান রাখা সম্ভব নয়। একই কারণে অনেক আগে নীলগিরি থেকে ছোট চা বাগান তুলে ফেলেছে চাষিরা। অন্য ফসলের চাষ শুরু করেছে। এখানে সেটা সম্ভব নয়। তাই প্রত্যেকে চা বাগানের জমি বিক্রির চেষ্টা করছে। বিজয়গোপালবাবু বলেন, "আমি নিজেই আমার চা বাগানের অর্ধেকটা বিক্রির চেষ্টা করছি। কারণ, আর দেনার ভার নিতে পারছি না।"