বাবুল হক, মালদহ: মালদহের আমেও চিনের ‘করোনা’! না, আতঙ্কিত হবেন না। তবে আমের এই মরশুমে এবার এই নয়া গুজবই যেন জেলাজুড়ে মুখে মুখে ফিরছে। তবে গুজব নয়, এটাই বাস্তব। এমনটাই দাবি শহরের মালদহের (Maldah) রথবাড়ি মোড়ের এক ফল বিক্রেতার। তিনি বলেন, “আমাদের জেলার আমকে ধ্বংস করতে বাজারে এসেছে চিনা পাউডার। এক প্যাকেটের দাম মাত্র সাত টাকা। পলিথিন আর কাগজের মিশেলে প্যাকেটটি তৈরি। ভিতরে কি আছে জানি না। শুনছি, চিন থেকে এসেছে। সেই প্যাকেট কিনে আমের ঝুড়িতে রেখে দিলেই কাজ হয়ে যাচ্ছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টায় কাঁচা আম পেকে লাল।”
আম পাকাতে এবার চিনা পাউডার নিয়েই চিন্তিত মালদহ। মাঠে নামতে হল জেলা পুলিশের দুর্নীতি দমন শাখার (EB) কর্তাদের। এতদিন আম পাকাতে রাসায়নিক কার্বাইড ব্যবহার করত এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। এবার তাদের হাতের মুঠোয় চিনা পাউডার। যা বিক্রি হচ্ছে কীটনাশক দ্রব্যের দোকানগুলিতে। মিলছে মুদিখানাতেও। একটি প্যাকেট মাত্র সাত টাকা। কার্বাইডকে টেক্কা দিচ্ছে চিনের এই ‘করোনা’! যা ভয়ংকর ক্ষতিকারক বলে চিকিৎসক মহলের দাবি। কী এই চিনা পাউডার? জানা গিয়েছে, ইথিলিন গ্যাসকে পাউডার তৈরি করে প্যাকেটবন্দি করা হচ্ছে। এই প্যাকেট ইথিলিন চিন (China) থেকে আসছে। এমনটাই দাবি ব্যবসায়ীদের। একটি আমের কার্টুনে একটি ‘করোনা’ প্যাকেট রেখে দিলেই কাজ হয়ে যাচ্ছে। কয়েক ঘণ্টায় কাঁচা আম পেকে যাচ্ছে।
[আরও পড়ুন: জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে কিশোরীকে ‘গণধর্ষণ’, মোবাইলে ভিডিও রেকর্ড, গ্রেপ্তার ২ অভিযুক্ত]
ক্ষতিকারক এই রাসায়নিক ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে মালদহ জেলার বেশ কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। ইতিমধ্যে মালদহের গোপালভোগ প্রজাতির আম (Mango) পাকতে শুরু করেছে। তবে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী গোপালভোগ ছাড়াও লক্ষণভোগ, কাঁচামিঠা ও কিছু গুটি প্রজাতির আম পরিপূর্ণ না হতেই গাছ থেকে পেড়ে নিচ্ছেন। ইথিলিন গ্যাসের প্যাকেট ব্যবহার করে আম পাকানো হচ্ছে। জেলার বাইরেও রাসায়নিকের সাহায্যে পাকানো আম পাঠানো হচ্ছে। এমনটা হতে থাকলে মালদহ জেলার আমের সুনাম নষ্ট হবে বলে মনে করছেন জেলার সাধারণ মানুষ থেকে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা। চলতি মরশুমে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মালদহ জেলায় আমের উৎপাদন অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেকটাই কম হয়েছে।
বাজারে এখনো চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে আম। কেজি প্রতি ৫০-৬০ টাকা। অসাধু ব্যবসায়ীরা আমের এই দাম পেতে ইথিলিন দিয়ে কৃত্রিম উপায়ে দ্রুত আম পাকাচ্ছেন। চিনা পাউডার আসার পর অধিকাংশ অসাধু ব্যবসায়ী কার্বাইডের পরিবর্তে এই গ্যাস ব্যবহার করছেন। যদিও ব্যবসায়ীরা ইথিলিন গ্যাসকে চিনা পাউডার নামে চেনেন। ইথিলিন দিয়ে আম পাকানো হলে উপরের খোসা দেখতে সুন্দর হয়। তাই ব্যবসায়ীরা এই পাউডার ব্যবহার করছেন। এই পাউডার ব্যবহারের বিষয়টি স্বীকার করেছেন জেলা উদ্যানপালন দপ্তরের কর্তারা। এই বিষয়ে নজরদারি চালানোর পাশাপাশি কৃষকদের সচেতন করতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান উদ্যানপালন দপ্তরের কর্তারা।
মালদহ মেডিক্যাল কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল পুরঞ্জয় সাহা বলেন, “কেমিক্যাল মিশ্রিত ফল খেলে মানুষ দীর্ঘমেয়াদি নানা রকম রোগে বিশেষ করে বদহজম, পেটব্যথা, জন্ডিস, গ্যাস্ট্রিক, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, লিভার ও কিডনি নষ্ট হওয়া-সহ ক্যানসারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এছাড়া মহিলারা এর প্রভাবে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দিতে পারেন। শিশুরা বিষাক্ত পদার্থের বিষক্রিয়ার ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।” জেলা উদ্যানপালন দফতরের মালদহের উপ-অধিকর্তা সামন্ত লায়েক জানিয়েছেন, তড়িঘড়ি গাছ থেকে আম পাড়া না উচিত। প্রাকৃতিক দুর্যোগে তেমনভাবে আমের ক্ষতি এখনও পর্যন্ত হয়নি। কিন্তু অনেক চাষিরা লোকসানের আশঙ্কা করে যদি আগেভাগে আম পেড়ে নেন সেটা ঠিক নয়। আর কার্বাইড বা ইথিলিন ব্যবহার একদম উচিত নয়। উদ্যানপালন দফতরের তরফে চাষিদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
[আরও পড়ুন: রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের অধীনস্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদে মুখ্যমন্ত্রী, সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভার]
মালদহ শহরে আমের বাজারগুলিতে চিনা পাউডার রুখতে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে জেলা পুলিশের দুর্নীতি দমন শাখা। মালদহ শহরের রথবাড়ি মোড় ও রবীন্দ্রভবনের অদূরে নিয়ন্ত্রিত বাজার সমিতির চত্বরে প্রত্যহ আমের বড় বাজার বসছে। অভিযোগ উঠেছে, আমের ঝুড়িতে প্রকাশ্যেই ইথিলিনের প্যাকেট রেখে আম পাকাচ্ছেন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। রাসায়নিক মিশিয়ে পাকানো আম স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। মালদহের জগৎবিখ্যাত আমে এই ভেজাল রুখতে বাজারগুলিতে আচমকা হানা দেওয়া হচ্ছে। অভিযোগ, মালদহের আমের বাজারগুলিতে রমরমিয়ে চলছে এই অসাধু কারবার। অনেক আম বিক্রেতাই কাঁচা আম কিনে ‘করোনা’ দিয়ে পাকিয়ে তা বিক্রি করছেন।
ইংলিশবাজার পুরসভার এক কাউন্সিলর বলেন, “খাদ্যে ভেজাল ঠেকানোর জন্য পুরসভার নিজস্ব কোনও পরিকাঠামো নেই। জেলা স্বাস্থ্য দপ্তরে একজন ফুড সেফটি অফিসার রয়েছেন। তাঁকে সঙ্গে নিয়েই অভিযান চালিয়ে থাকে পুরসভার আধিকারিক দল। চিনা পাউডার দিয়ে আম পাকানোর অভিযোগ উঠেছে। আমের বাজারগুলিতে পুরসভার তরফেও অভিযান চালানো উচিত।’’ মালদহ মার্চেন্ট চেম্বার অব কমার্সের সম্পাদক জয়ন্ত কুণ্ডু বলেন, “রাসায়নিক দিয়ে আম পাকানো নিষিদ্ধ রয়েছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এই অন্যায় কাজ করছেন। প্রশাসনের পাশাপাশি আমরাও তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।”