আমরা সকলেই ফুলের সৌন্দর্য এবং অর্থকরী বিষয়ে অবগত হলেও শুকনো ফুলের গুরুত্ব সম্বন্ধে বহুল পরিচিত নই। তবে, ভারতবর্ষ বিশ্বের সর্বাধিক ফুলের রপ্তানিকারী (৩২২ কোটি অর্থমূল্য) দেশ। আর ভারতবর্ষের ফুল সংক্রান্ত রপ্তানির ৭০ শতাংশ আসে এই শুকনো ফুল থেকে। প্রধানত যে দেশগুলিতে রপ্তানি হয় তা হল জাপান, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, আরব আমিরশাহি ইত্যাদি। লিখেছেন ইন্ডিয়ান এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ফ্লোরিকালচার অ্যান্ড ল্যান্ডস্কেপিং ডিভিশনের গবেষক সংহিতা রায়।
শুকনো ফুল ও তার গুরুত্ব তাজা ফুলের মেয়াদ খুবই সীমিত। সেই কারণেই শুকনো ফুল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এছাড়াও প্রধান বিষয় হল প্রচুর পরিমাণ ফুল চাষির মাঠে কিংবা বাজারে নষ্ট হয় সঠিক সময়ের মধ্যে বিক্রি না হওয়ার দরুন। তাছাড়াও অসময়ে সবজি উৎপাদন সম্ভব হলেও ফুলের ক্ষেত্রে তা জনপ্রিয়তা অর্জন করে উঠতে পারেনি নানাবিধ সমস্যার কারণে। তাই, সকল বিষয়কে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, শুকনো ফুল যেমন দীর্ঘমেয়াদি অর্থাৎ পচনশীল ফুলের সৌন্দর্যকে ধরে রাখা সম্ভব, তেমনই অবিক্রিত ও অতিরিক্ত ফুলকে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে অর্থকরী রূপ দেওয়া যেতে পারে। এছাড়াও, বিভিন্ন বন্য ও অপ্রচলিত ফুল, পাতা, কিংবা গাছের ছাল, মূল, কাণ্ডের নানা অংশকে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই ফিউশন-ই আয়ের দিশা দিচ্ছে।
ফুল শুকনো করার পদ্ধতি
বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করে প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী ফুলের আর্দ্রতা কমিয়ে শুকিয়ে নেওয়া সম্ভব।
পদ্ধতিগুলো হল
১) প্রেস ড্রাইং
প্রেস ড্রাইং পদ্ধতিতে একটি "প্লান্ট প্রেস" নামক কাঠের তৈরি বর্গাকার যন্ত্রের সাহায্যে ব্লটিং পেপার ব্যবহার করে খুব কম খরচে বিভিন্ন ফুল কিংবা পাতাকে শুকনো করা যায়। শুকনো ফুল তৈরি হতে এই পদ্ধতিতে ৫-৮ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। প্রতি দুই থেকে তিন দিন অন্তর ওই বর্গাকার যন্ত্রের মধ্যবর্তী ব্লটিং পেপার বদলে দিতে হবে।
২) এয়ার ড্রাইং বা বাতাসে শুকনো
এটি খুবই সাধারণ ও সবচেয়ে কম খরচে করা সম্ভব। পরিবেশ নির্ভর এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন ফুল কিংবা পাতাকে খোলা হাওয়ায় দড়ির সাহায্যে ক্লিপ দিয়ে বা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়। তবে এক্ষেত্রে ফুল বা পাতার প্রকৃত আকার বা আকৃতি বজায় রাখা সম্ভব হয় না।
[আরও পড়ুন: বাংলাদেশে শুরু কাঁচালঙ্কার রপ্তানি, খুশি বালুরঘাটের কৃষকরা]
৩) এম্বেডেড ড্রাইং
এম্বেডেড ড্রাইং পদ্ধতিতে ফুল/ পাতাগুলিকে একটি মাটির/ কাঁচের/ টিনের পাত্রে ভর্তি করে রাখা সিলিকা জেল/ সাদা বালির মধ্যে যথাযথ ভাবে স্থাপন করা হয় এবং জেল/ বালির দ্বারা ঢেকে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে তৈরি শুকনো ফুল গুলির আকার আকৃতির এবং রং এর কোনও। পরিবর্তন হয় না। তবে ঘরের তাপমাত্রায় রাখলে যে সময় লাগে তার চেয়ে অনেক কম সময় লাগে যদি মাইক্রোওয়েভ ওভেন বা সোলার কুকার এর সাহায্য নেওয়া হয়।
৪) গ্লিসারিন ড্রাইং
গ্লিসারিন ড্রাইং পদ্ধতি সাধারণত পাতাবাহার জাতীয় উদ্ভিদাংশের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়। এক্ষেত্রে, পতাবাহারের রং এবং নমনীয়তা বজায় থাকে, ফলে বিভিন্ন শিল্পকর্মের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায়।
৫) ফ্রিজ ড্রাইং
ফ্রিজ ড্রাইং পদ্ধতিতে ফুলকে শূন্য ডিগ্রি সেলিয়াসের চেয়েও কম তাপমাত্রায় রাখা হয়। এই পদ্ধতিতে তৈরি শুকনো ফুলের রং যেমন বজায় থাকে তেমনই কিছুটা গন্ধও বজায় থাকে।
৬) ওয়াটার ড্রাইং/ জলে শুকনো
ওয়াটার ড্রাইং শব্দটি শুনে অবাক লাগলেও কিছু কিছু ফুলকে এই পদ্ধতিতে শুকনো সম্ভব। ফুলের লম্বা কাণ্ডের অন্তিম প্রান্তকে দুই ইঞ্চি গভীর জলে দাঁড় করিয়ে শুষ্ক অন্ধকার আবদ্ধ ঘরে রাখা হয়। পাত্রের জলকে বাষ্পীভূত হতে এবং কাণ্ডের দার শুষে নিতে দেওয়া হয়। হাইড্রানজিয়া, সেলোসিয়া, বাবলা ফুল ইত্যাদি এই পদ্ধতিতে শুকনো হয়।
শুকনো ফুল দিয়ে তৈরি বিভিন্ন উৎপাদিত বস্তু
বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে তৈরি শুকনো ফুলের ব্যবহার করে নানা ধরনের সামগ্রী তৈরি করা যেতে পারে।
১) জৈব আবির
অপরাজিতা, গাঁদা, পলাশ, কাগজফুল, সবুজ ও লাল পালংশাকের পাতা ইত্যাদি ব্যবহার করে জৈব আবির তৈরি করা যেতে পারে। ফুল গুলিকে উষ্ণ গরম জলে আগের দিন রাতে ভিজিয়ে রেখে পেস্ট করে নিয়ে তা চালুনিতে ছেঁকে সোপস্টোন পাউডারের সাথে সঠিক অনুপাতে মিশিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। তারপর তা মিহি গুঁড়ো করে বিভিন্ন সুগন্ধি মিশিয়ে প্যাকেট করে নিলেই বাজারে বিক্রি করার জন্য আবির একেবারে তৈরি।
২) ধূপকাঠি
গাঁদা ফুলের শুকনো পাপড়ি গুঁড়ো করে নিয়ে তা ভালভাবে চালুনিতে চেলে নিয়ে তারয়সাথে গদের আঠা, ধুনো গুঁড়ো, নারকেল তেল, সুগন্ধি (পছন্দ এবং চাহিদা অনুযায়ী) এবং জিগাত গুঁড়ো (Jigat powder) সঠিক অনুপাতে মিশিয়ে মিশ্রণটিকে হাত দিয়ে কাঠির সাহায্যে ধূপকাঠির আকার দিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে এবং প্যাকেট করে নিলেই বাজারে বিক্রি করার উপযোগী হয়ে উঠবে।
৩) জৈব সিঁদুর
সঠিক অনুপাতে লাল গোলাপের পাপড়ির গুঁড়ো (২৫ গ্রাম), ঘৃতকুমারী (৫ গ্রাম), ভিটামিন-ই ক্যাপসুল (৩ টি) ও গোলাপ জল (১০ মিলিলিটার) মিশিয়ে জৈব সিঁদুর তৈরি করা যেতে পারে।
৪) শ্যাম্পু
গাঁদা ফুলের পাপড়ির গুঁড়ো (২৫ গ্রাম), ফ্ল্যাক্স বীজ (২০ গ্রাম), শিকাকাই (২৫ গ্রাম), আমলকী (২৫ গ্রাম), রিঠা (২৫ গ্রাম), গোলাপজল (২৫ মিলিলিটার) ভালভাবে মিশিয়ে ৩৫০ মিলি লিটার জলে ফুটিয়ে নিয়ে নানা সুগন্ধি মিশিয়ে শ্যাম্পু তৈরি করা হয়।
৫) রেজিন সামগ্রী
রেজিন ব্যবহার করে শুকনো ফুল, পাতাবাহার, পাতা দিয়ে নানা ধরনের কানের দুল, গলার মালা, হাতের চুড়ি ইত্যাদি তৈরি করা সম্ভব। এছাড়াও, কলম দানি, পেপার ওয়েট, মোমবাতি স্ট্যান্ড, অ্যাশ ট্রে প্রভৃতি দৃষ্টি নান্দনিক সামগ্রী তৈরি করা যেতে পারে। প্রেস ড্রাইং পদ্ধতিতে তৈরি শুকনো ফুল বা পাতাবাহার দিয়ে নানা ধরনের গ্রিটিংস কার্ড, দেওয়াল ক্যালেন্ডার, টেবিল ম্যাট ইত্যাদি তৈরি করা যেতে পারে।
৬) পটপৌরী
পটপৌরী হল শুকনো ফুল, পাতা, ফুলের কুঁড়ি, বীজ, কাণ্ড অথবা শিকড়ের এক বিশেষ সংমিশ্রণ যা থেকে সুগন্ধ নিঃসৃত হয়। পটপৌরী তৈরি করতে এক বিশেষ ধরণের ফিক্সেটিভ ব্যবহার করা হয় যাতে অনেকদিন পর্যন্ত সুগন্ধ নিঃসৃত হয়। গোলাপ ফুল, গাঁদা ফুল, বোতাম ফুল, পদ্ম ফুলের শুঁটি ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় পটপৌরী তৈরিতে। বাজার থেকে কেনা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির যে কেমিক্যাল মিশ্রিত সুগন্ধি আমরা ঘর বা গাড়িতে ব্যবহার করি, তার বদলে এই জৈব পটপৌরী ব্যবহার করা যেতে পারে যা কিনা সৌন্দর্যও বৃদ্ধি করবে।
৭) গুলকন্দ
গুলকন্দ তৈরির ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ ধরনের গোলাপের প্রজাতির ব্যবহার করা হয় (China Rose, French Rose, Damask Rose) I গোলাপের পাপড়ি, চিনি, মধুর সংমিশ্রণে তৈরি গুলকন্দ মুখশুদ্ধি অথবা মুখরোচক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
[আরও পড়ুন: মাত্র ৬ মাসেই লাখপতি, জেনে নিন লেমন গ্রাস কাটার নিয়ম]
সতর্কতা
শুকনো ফুল অথবা শুকনো ফুল দিয়ে তৈরি সকল সামগ্রীকেই যত্ন সহকারে ভালভাবে বায়ুনিরোধ ভাবে প্যাকিং করে রাখতে হবে। জলীয় বাষ্প শোষণ করলে সৌখিন জিনিস গুলিতে বিভিন্ন রোগ পোকার আবির্ভাব ঘটবে এবং সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে ও গ্রহণযোগ্যতাও হ্রাস পাবে।
বিক্রির বাজার
বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী উৎপাদনের পর প্রশ্ন আসে তা বাজারজাত করতে হবে কেমন করে? বর্তমানে এই শুকনো ফুল ব্যবহার করে তৈরি এই সকল দৃষ্টি নান্দনিক ও পরিবেশ বান্ধব জিনিসের চাহিদা দেখা গিয়েছে। সরকার কর্তৃক বিভিন্ন হস্ত শিল্পের মেলা, তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের মেলাতেও এই ধরনের জিনিসের বিক্রি সম্ভব। বিভিন্ন শপিং মলে এই সমস্ত জিনিসের চাহিদা দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া, বিভিন্ন এনজিও রয়েছে যারা এই ধরনের প্রোডাক্ট আপনাদের কাছ থেকে কিনে নিতে পারে। আমাদের কলকাতা শহরেই রয়েছে বিভিন্ন কোম্পানী (ওয়ার্ল্ড ড্রাইড ফ্লাওয়ারস্, সিঙ্গভি ইন্টারন্যাশনাল, প্রেম এক্সপোের্টস্, শুভম ট্রেক্সিম লিমিটেড ইত্যাদি) যারা তাদের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন জায়গা থেকে শুকনো ফুলের তৈরি প্রোডাক্ট ন্যায্য মূল্যে সংগ্রহ করে থাকে। সাধারণত প্রতি ধরনের দ্রব্যের কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ পিস তৈরি করতে হবে এবং চাহিদা অনুযায়ী তা বাড়াতে হবে। যদি সম্ভব হয় ই-মার্কেটিং অর্থাৎ অনলাইনে বিক্রি সম্ভব এবং সরকারি সুবিধা কেন্দ্র MSME (Micro, Small and Medium Enterprise)-তে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমেও সহজে বিক্রয় সম্ভব।
বিভিন্ন সামগ্রী পিছু লাভের হার
প্রতি একটি উৎপাদিত দ্রব্য প্রতি লাভের হার।
বর্তমানে বিভিন্ন সংস্থা অনলাইনের মাধ্যমে শুকনো ফুলের সরবরাহ করছে। তবে সেক্ষেত্রে ক্রেতাকে একটু বেশি মূল্য প্রদান করতে হবে। তাছাড়া, এই শুকনো ফুলের যোগান নিয়ে অথবা শুকনো ফুল বানিয়ে নিয়ে তা বিভিন্ন শিল্পকর্মে ব্যবহার করে লাভের দিশা মিলতে পারে। বর্তমানে, এই শিল্পের কেবল উত্থান হয়েছে বললেই চলে। তবে ভবিষ্যতে এই ক্ষুদ্র শিল্প বিশালাকার হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। তাই প্রচলিত হওয়ার পূর্বে তাৎক্ষণিক কাঁচামালের যোগান পাওয়াটা একটু কষ্টসাধ্য।
এই বিষয়ে আরও বিষদে জানতে এবং প্রশিক্ষণ নিতে আপনারা আমাদের কল্যাণীর বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী ডঃ সুপ্রিয়া রায় মণ্ডলের (ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ, প্রাক্তন মহিলা বিজ্ঞানী) সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। আপনারা ওঁনার সাথে এই নম্বরে ৯৪৩৩৩০৭৫৬২/ এই মেল আইডিতে-anipriyo@gmail.com যোগাযোগ করতে পারেন।