ভারতবর্ষের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ আনারস চাষে অগ্রণী রাজ্য। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের জেলাগুলিতেই মূলত এই ফসলের চাষ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। উত্তরের জেলাগুলির মধ্যে, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহারেই মূলত আনারস চাষ হয়। রাজ্যে আনারস চাষ হয় প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। পড়ুন প্রথম পর্ব।
পশ্চিমবঙ্গে আনারসের জনপ্রিয় জাতগুলি হ'ল জায়ান্ট কিউ, কুইন এবং মরিশাস।
ক) জায়ান্ট কিউ:
সবচেয়ে পরিচিত জাত এবং প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের উপযোগী। গড় ওজন দুই থেকে আড়াই কেজির মতো।দেরিতে পাকে। পাকলে ফলের রঙ হলদে, ছিবড়ে প্রায় নেই বললেই চলে। খুব রসালো। এর চোখগুলি অগভীর হওয়ায় যন্ত্রের সাহায্যে ছাড়ানো এবং টিনজাত করা সহজ হয়।
খ) কুইন:
ফল অপেক্ষাকৃত ছোট এবং লম্বাটে গড়নের। গড় ওজন ১.২ কেজি। সোনালি হলুদ রঙের ফল।
গ) মরিশাস:
মূলত টেবিল পারপাসে ব্যবহার হয়। পাতা কালচে সবুজ বর্ণের, মাঝের শিরে লালচে দাগ এবং পাতার ধারে লাল রঙের কাঁটা থাকে। তেউড়েও কাঁটা থাকে। মাঝারি আকৃতির ফল। গড় ওজন দেড় থেকে পৌনে দুই কেজি। পাকলে ফলের রঙ হলদে। স্বাদ খুব মিষ্টি।
চারা নির্বাচন:
আনারস গাছের বিভিন্ন অংশ থেকে চারা বেরোয়। সেগুলো হল গোড়া থেকে বেরোনো চারা, উপরের চারা বা স্লিপ, মাথার চারা বা ক্রাউন। দেখা গেছে গোড়ার চারা একটু লম্বা হলেও ফল আসে তাড়াতাড়ি। বসানোর ৪৭৮ দিনের মধ্যেই এজাতীয় বেশিরভাগ চারায় ফুল ধরে। অন্য চারাগুলিতে ফুল আসতে দেরি হয়।
আনারস চাষের মাটি:
যে কোন জমিতেই চারা লাগানো যেতে পারে, তবে আনারস চাষের জন্য বেলে-দোঁয়াশ মাটিই শ্রেষ্ঠ। অম্ল মাটি, যার পিএইচ ৫.৫-৬.০ সে মাটি আনারাস চাষের পক্ষে আদর্শ। যে অঞ্চলে বছরে অন্তত ১০০-১৫০ সেমি বৃষ্টিপাত হয় সেখানে আনারস ভাল হয়।
চারার আকার বড়, ওজন বেশি হলে ফলও তাড়াতাড়ি ধরে। বসানোর আগে গোড়ার দিকটা বোর্দো মিশ্রণ দিয়ে শোধন করলে চারা পচে না। ঘোর বর্ষার সময়ে ফল না তোলাই ভালো। চারা বসানোর ১২ -১৫ মাসের মাথায় ফুল আসে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের জেলাগুলিতে অক্টোবর-নভেম্বরে, অন্যত্র জুন-জুলাই মাসে চারা বসানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। হেক্টর প্রতি ২০-২৫ হাজার চারা লাগানো যায়। ঘন করে লাগালে জমিতে আগাছার উপদ্রব কমে। ঘন করে লাগালে পুষ্ট ফলগুলি কড়া রোদের প্রভাব থেকে খানিকটা রক্ষা পায়। তবে এধরনের জমির ফল আকৃতিতে কিছুটা ছোট হয়।
[আরও পড়ুন: জোগানে ঘাটতি রুখতে পিঁয়াজের বীজ উৎপাদনে কামাল]
সার প্রয়োগ:
আনারসের জমিতে নাইট্রোজেন এবং পটাশের চাহিদা থাকে বেশি। ফসফরাস অপেক্ষাকৃত কম প্রয়োজন হয়। তবে মাটি পরীক্ষা করে জমির পুষ্টি নির্ধারণ প্রয়োজন। ঘন করে ফসল লাগালে সুষম খাদ্যের চাহিদাও বেশি হয়। জমি তৈরির সময় হেক্টর প্রতি ২৫-৩০ টন কম্পোস্ট প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এছাড়াও গাছ প্রতি ১০ গ্রাম নাইট্রোজেন, ৪ গ্রাম ফসফরাস এবং ১০ গ্রাম পটাশ সার দিতে হয়। ফসফরাস, পটাশ এবং অর্ধেক নাইট্রোজেন জমি তৈরির সময়ে আর বাকি নাইট্রোজেন চাপান হিসেবে মার্চ-এপ্রিলে ফুল আসার সময় প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া প্রয়োজন মতো অণুখাদ্যও প্রয়োগ করা প্রয়োজন। জমিতে ম্যাগনেসিয়াম সালফেট প্রয়োজন মতো প্রয়োগ করলে উৎপাদন বাড়ে।
ফসলের পরিচর্যা:
আনারসের জমিতে আগাছা নিয়ন্ত্রণ খুব প্রয়োজনীয় একটি পদক্ষেপ। যথাযথ আগাছা দমনের উপর ফলন অনেকাংশেই নির্ভর করে। জমি তৈরির সময় কাশ, উলু প্রভৃতি আগাছার গোড়া ভাল করে বেছে তুলে ফেলা প্রয়োজন। এর পর জমি তৈরি করে রেখে দিলে নতুন যে আগাছা বের হয় তা আগাছা নাশক প্রয়োগে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে এজাতীয় নাশক যেন কোনওভাবেই গাছের সংস্পর্শে না আসে। আনারস যেহেতু মূলত বৃষ্টি নির্ভর চাষ, জমিতে মাল্চ ব্যবহার করলে জমির রস সংরক্ষিত হয় এবং আগাছা নিয়ন্ত্রণও হয়। কালো প্লাসিকের চাদর বা জৈব আচ্ছাদনও ব্যবহার করা যেতে পারে। আনারসের জমিতে পরিচর্যা কিন্তু খুব শ্রম সাধ্য এবং কৃষি শ্রমিকরা সে জমিতে কাঁটা ইত্যাদির কারণে সহজে কাজ করতে চান না।
(বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল ও বাগিচা পরিচর্যা বিভাগ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সুপারিশ অনুযায়ী এএপিপি কর্তৃক প্রকাশিত।)