shono
Advertisement

মাটি ছাড়া সম্ভব চাষ! জেনে নিন ‘মাটিবিহীন চাষে’র খুঁটিনাটি

ভারতে হাইড্রোপনিক্স বা মাটিবিহীন চাষ ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে।
Posted: 05:47 PM Nov 15, 2023Updated: 08:50 PM Nov 15, 2023

‘মাটিবিহীন চাষ প্রযুক্তির’ একটি পদ্ধতি হাইড্রোপনিক্স। এটি একটি শিল্পকলা এবং আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তি, যার দ্বারা মাটি ছাড়া যে কোনও পাত্রে বা আধারে খনিজ খাদ্য দ্রবণ জলে গুলে শাকসবজি, স্যালাড জাতীয় ফসল, দানাশস্য, ফুল, ফল, বাহারি গাছপালা, ভেষজ গাছগাছড়ার সহজে কম সময়ে বেশি ফলন-সহ চাষবাস করা সম্ভব। লিখেছেন রাজ্য কৃষি পরিচালন ও সম্প্রসারণ প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (স্যামেটি)-এর কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের বরিষ্ঠ অধ্যাপক ড. সৌরেন্দ্রনাথ দাস।

Advertisement

হাইড্রোপনিক্স কথাটি এসেছে দুটি গ্রিক শব্দ থেকে। Hydro মানে জল ও Ponos মানে কাজ করা অর্থাৎ জল নিয়ে কাজ। দ্রবণীয় খাদ্য উপাদান (নিউট্রি কালচার) ব্যবহারের মাধ্যমে চাষ। একে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। যথা কেমিকালচার, কৃত্রিম বৃদ্ধি, মাটিবিহীন কৃষি, অ্যাকোয়াকালচার (দ্রবণীয় খাদ্য) ব্যবহার করে গাছপালার চাষ, অলোরি কালচার বা সবজি চাষ এবং ট্যাংক ফার্মিং ইত্যাদি।

হাইড্রোপনিক্স হচ্ছে জলের কাজ যার দ্বারা সহজ পদ্ধতিতে বিভিন্ন আকৃতির পাত্রে বালি, মুড়ি, পাথর, ইটভাঙ্গা বস্তু, পারলাইট, ভার্মিকিউলাইট ইত্যাদি জড়বস্তুর উপর বীজ বপন বা চারা লাগিয়ে চটজলদি খাদ্য ফসল (শাকসবজি), তণ্ডুল জাতীয় ফসল (ধান, গম), ক্ষুদ্র দানাশস্য (মিলেট জাতীয় ফসল), ভেষজ গাছ-গাছড়া, ফুল-ফল ইত্যাদি চাষ করা সম্ভব। এটি হচ্ছে প্রকৃতি এবং প্রযুক্তির একসঙ্গে আনয়ন। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে গাছ মাটি বিহীন আধারের খাদ্যদ্রব্যে যথাযথ পরিমাণে ব্যবহারের সাহায্যে বৃদ্ধি লাভ করে। যাতে গাছের বৃদ্ধির জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় মৌলিক পদার্থ যথাযথ ঘনীকরণ অবস্থায় শিকড় দ্বারা গ্রহণ করে।‌‌

উদ্দেশ্য: এই মাটিবিহীন চাষের উদ্দেশ্যগুলি হল
* গ্রাম ও শহরের জমিহীন জনগণকে এই বিকল্প পদ্ধতিতে চাষের আওতায় আনা।
* পারিবারিক শ্রম কাজে লাগিয়ে বিকল্প আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা।
* প্রতিকূল পরিবেশে খাদ্যের যোগান ঠিক রাখা সম্ভব।
* বিভিন্ন শাকসবজি, দানাশস্য, ফুল-ফল, স্যালাড জাতীয় ফসল, ভেষজ গাছ-গাছড়ার চাষ হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ছড়িয়ে দেওয়া।

[আরও পড়ুন: রুখাশুখা পুরুলিয়ায় কৃষিবিপ্লব, পুকুরে কই-পাবদা-চিতল-গলদা চিংড়ি চাষ]

হাইড্রোপনিক্সের সুবিধা
হাইড্রোপনিক্স এর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক এই দুটোই বৈজ্ঞানিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। যার সঙ্গে উদ্ভিদ শারীরবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, উদ্যান বিজ্ঞান, শস্যবিজ্ঞান এবং বিবিধ পরিবেশগত ও রোগ পোকা নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির মাধ্যমে বাণিজ্যিক ফসল হিসেবে যথাযথ নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় চাষ করা হয়।
হাইড্রোপনিক্সের ইতিহাস
* ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হাইড্রোপনিক্স-এর মূলনীতির প্রত্যক্ষ প্রমাণ প্রাচীন ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগানে দৃশ্যমান।
* ৯০০ থেকে ১০০০ খ্রিস্টাব্দে সৃষ্ট টেনোকটিটলান হ্রদের জলাভূমিতে অ্যাজটেক্স-এর ভাসমান বাগান। যা এখন মেক্সিকোর বিশাল সেন্ট্রাল ভ্যালিতে অবস্থিত।
* ১২০০ শতাব্দীর শেষে মার্কো পোলো চীনে ঝুলন্ত বাগানের দৃশ্য লিপিবদ্ধ করে গেছেন।
* ১৬২০ সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস বেকন তাঁর একগুচ্ছ হাইড্রোপনিক্স গবেষণায় মাটিহিন বাগানে চাষের কথা বলে গেছেন।
* ১৬৯৯ সালে অন্য এক ইংরেজ বিজ্ঞানী জন উডওয়ার্ড নিজের গবেষণার উপসংহারে বলেন যে গাছের সঠিক বৃদ্ধি জলের সাথে খাদ্য উপাদান পরিপোষকের মধ্য দিয়ে সুন্দরভাবে হয়। কিন্তু পাতিত (ডিসটিল্ড) জলে ভাল হয় না।
* ১৯৩০ সালে উইলিয়াম জেরিক, বার্কেলের বিজ্ঞানী মাটি বিহীন বাগানের সুবিধার প্রদর্শন ক্ষেত্র দেখা। হাইড্রোপনিক্স-এর সাথে তাঁর নামের সুখ্যাতি জড়িয়ে গেছে।
* ১৯৩৮ সালে অন্য আরও দুইজ বার্কেলের বিজ্ঞানী ডেনিশ হোগল্যান্ড ও ড্যানিয়েল আর্ননের লেখা হাইড্রোপনিক্স সম্বন্ধে ‘দ্যা ওয়াটার কালচার মেথড ফর গ্রোইং প্ল্যান্ট উইদাউট সয়েল’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাটিবিহীন চাষবাসের প্রযুক্তি ব্যবহার করে টাটকা সবুজ ফসল চাষ হচ্ছে। নিউইয়র্কের বিশাল বিশাল বহু

তল বাড়ির ছাদে, কার্নিশে, ব্যালকনি, জানালা, অব্যবহৃত খাদ্য গুদামে চলছে হাইড্রোপনিক্স প্রযুক্তির চাষ। ফ্রান্স, আমেরিকা, চিন, জাপান আধুনিক হাইড্রোপনিক্স চাষ প্রযুক্তির মাধ্যমে নানাবিধ সবজি ও ফসল উৎপাদন দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে। বর্তমানে আমাদের বিভিন্ন শহরের প্রাত্যহিক নাগরিক জীবনে বেশ কিছু বাড়ির ছাদের আয়তন অনুযায়ী ছোট বা বৃহদাকার হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতিতে বাগান চাষ করে বিভিন্ন শাকসবজি, ফুল-ফল, দানাশস্য। ভেষজ গাছগাছড়ার চাষও শুরু হয়েছে। সারা বছর ধরে এখানে উৎপাদন হচ্ছে পুষ্টিকর কালো টম্যাটো এবং নানাবিধ শাক সবজির উন্নত জাত, লম্বা টম্যাটো, ব্লু বেরি ইত্যাদি। ভিটামিন সি এবং উচ্চ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ স্বাস্থ্য সুরক্ষার উপযোগী ফসল।

চাষের কলাকৌশল ও বিভিন্ন পদ্ধতি
প্রধানত দুই ধরনের কৌশলে হাইড্রোপনিক্সের চাষ হয়। ১) দ্রবণ চাষ (সলিউশন কালচার) এবং ২) মাধ্যম চাষ (মিডিয়াম কালচার)। দ্রবণ চাষে কোন কঠিন মাধ্যম (সলিড মিডিয়াম) শিকড়ের জন্য ব্যবহার করা হয় না। শুধুমাত্র নিউট্রিয়েন্ট সলিউশন ব্যবহার করা হয়। মাধ্যম চাষ পদ্ধতিতে একটি কঠিন মাধ্যম উদ্ভিদের শিকড়কে ধরে রাখার জন্য থাকে এবং এটি বিভিন্ন প্রকারের হয়। যথা বালি চাষ, গ্রাভেল পালন (পাথরের টুকরো, ঝামা পাথর, শিলাগুটি দিয়ে চাষ) রকউল, ভার্মিকিউলাইট, পারলাইট চাষ, নারকেলের ছোবড়ার আঁশ/ তন্তু/ ধানের তুষ/ চিনাবাদামের মোড়ক প্রভৃতি। আগামী ১৫ বছরের মধ্যে আমাদের খাদ্য চাহিদার স্বপ্ন পূরণে প্রতিটি ঘরে এবং জমির মালিককে এই সর্বাধুনিক প্রযুক্তি কলাকৌশল ভারতের সর্বত্র সম্প্রসারণ করা। প্রতিটি কৃষকের দুঃখ দুর্দশা ঘুচে আগামী ওই সময়ের মধ্যে এই ‘কাটিং এজ টেকনোলজি’/ প্রযুক্তির যোগান দেওয়া। প্রতিটি ভারতবাসী যেন বলতে পারেন ‘এটি আমাদের গর্ব, ভারতের একজন কৃষক হিসেবে আমি গর্বিত’।

হাইড্রোপনিক্স প্রযুক্তির সুবিধা
* মাটিতে ফসল চাষের থেকে এতে অনেক বেশি ফলন লাভ।
* খুব কম সময়ে ফসলের খুব দ্রুত বৃদ্ধি ও সময়ের সাশ্রয় হবে।
* চাষে খরচ অনেক কম। প্রতিদিন টাটকা সবজি পেতে পারি।
* কোনও আগাছা তোলার ব্যাপার নেই। আর্থিক সাশ্রয় হবে কিছুটা।
* মাটিকর্ষণের মতো কঠিন শ্রম নেই। বাড়ির বয়স্ক ব্যক্তিরা সহজে এই কাজে যুক্ত হতে পারেন।
* যেখানে সাধারণ সম্ভব নয়, সেখানে হাইড্রোপনিক্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রিন হাউসের মধ্যে সংরক্ষিত চাষ সম্ভব।
* চাষিদের চাষের জমি না থাকলেও বাড়ির ছাদে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বেশি ফলন ফলানো সম্ভব। এতে জায়গা পুরোপুরি বাঁচানো যাবে।
* শহরে বা গ্রামে নিজের বসতবাটির ছাদ, অব্যবহৃত গুদামঘর, পতিত জমিকে শস্যশ্যামেলা করা যাবে।
* সারা বছর ধরে ঘরের চাহিদা পূরণে সবজি ও অন্যান্য ফসলের চাষ যেমন; ফল, ফুল, ভেষজ উদ্ভিদ, স্যালাড জাতীয় সবজি, বাহারি ফুল ও বিভিন্ন গাছপালা চাষ করা যাবে।
* অতিরিক্ত ফসল বাজারে বিক্রি করে আয় বাড়ানো সম্ভব।
* পরিবারের স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
* খুব বেশি লাভজনক, সহজ সরল চাষ পদ্ধতি টাটকা খাদ্যশস্য যোগানের ফলে মানুষের স্বাস্থ্য ঠিক রাখে।
* বাণিজ্যিক চাষের পরিকল্পনা করে শহর বা শহরতলির ফ্ল্যাটে, বাড়ির ছাদ, ব্যালকনি, জানালার ধারে, কার্নিশে সবজি, ফুলের চাষ সম্ভব।
* শহরের বাসিন্দা এবং কাজের লোকেরা বিশেষ করে শিল্পাঞ্চলের এলাকার তাদের বৃহৎ বারান্দায় ব্যবহার কমই করে থাকেন। এইসব জায়গায় হাইড্রোপনিক্স প্রযুক্তির সাহায্যে নিত্যদিন স্বাস্থ্যকর সবুজ ফসল কম খরচে ফলাতে পারেন।
* মরুভূমি, পাথুরে এবং শুখা এলাকায়, পার্বত্য জেলাগুলিতে বা অনুর্বর বন্ধা জমিতে হাইড্রোকনিক্স প্রযুক্তিতে প্রচুর তাজা ফসল ফলানো সম্ভব।
* এই পদ্ধতি একটি চিত্তাকর্ষক শখ এবং লাভজনক পেশা হিসেবে প্রতিটি দেশের মানুষের ঘরে ঘরে সম্প্রসারিত হবে।

হাইড্রোপনিক্সের বিভিন্ন বাধা ও সমস্যা 
* হাইড্রোপনিক্স বাগান চাষে দরকার সব সময় একাগ্রতাযুক্ত প্রতিশ্রুতি।
* অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি সম্বন্ধে জ্ঞান থাকা জরুরি।
* হঠাৎ ব্যবস্থা পদ্ধতির ব্যর্থতা উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
* প্রাথমিকভাবে খরচ অনেকটা বেশি।
* বদ্ধ পদ্ধতিতে জলের সংযুক্তির মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া হয় বলে খুব অল্প সময়ে কৃষি শত্রুর আক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
* এক ভাবে পর্যবেক্ষণ জরুরি।
* শস্যখেতের (ফিল্ড কন্ডিশন) তুলনায় এখানে উৎপাদন কিছুটা সীমিত।

মাটিবিহীন বাগান চাষের আকর্ষণীয় ব্যবহার হচ্ছে প্রকৃতি, জৈবিক কৃষি ও উদ্যান যত ফসলের বিজ্ঞান বিষয়ে গভীর জ্ঞানের সমন্বয়। তাই হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতিতে চাষ প্রকৃত বিস্ময়কর, অল্প সময়ে অধিক পরিমাণে বিভিন্ন ফসলের ফলন পাওয়া যায়। তাই এর বাণিজ্যিক চাষবাস সারাবিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয়। ভারতে এই হাইড্রোপনিক্স বা মাটিবিহীন চাষ ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ভারতীয় কৃষি গবেষণা সংস্থা (আইসিএআর), বিভিন্ন রাজ্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও আরও অন্যান্য গবেষণা সংস্থা, রাজ্য কৃষি দপ্তর গুলি এ বিষয়ে বিভিন্ন কলাকৌশল বা খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলি জানিয়ে এই চাষের অপরিহার্যতা বাড়িয়ে তুলবে।

[আরও পড়ুন: যার গন্ধে পুজো পুজো ভাব আসে, সেই শিউলি ফুলের ভেষজ গুণ জানলে চমকে যাবেন]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement