কাঁঠাল একটি বহুমুখী প্রজাতির খাদ্য, কাঠ, জ্বালানি, পশুখাদ্য, ঔষধি ও শিল্পজাত পণ্য। এই ফলের আঠা বার্ড লাইম হিসাবে, গাছের ছাল দড়ি ও কাপড় তৈরিতে, কাষ্ঠল অংশ দিয়ে আসবাবপত্র ও সংগীতের সরঞ্জাম প্রস্তুত হয়। কাঁচা ফল (এঁচোড়) রান্না করে ও আচার প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হয়। পাকা অবস্থায় সরাসরি ফল হিসাবে খাওয়া যায়। পাকা ফলের শাঁস থেকে জ্যাম, জেলি, ক্যান্ডি, মার্মালেড এবং আইসক্রিম তৈরি হয়। বীজ শুকিয়ে ভেজে বা রান্নায় সবজি হিসাবেও খাওয়া যায়। ফল, পাতা এবং বাকল-সহ গাছের বিভিন্ন অংশ ওষুধে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। লিখেছেন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল বিজ্ঞান বিভাগের গবেষক তন্ময় মণ্ডল ও অধ্যাপক ড. ফটিককুমার বাউড়ি। পড়ুন প্রথম পর্ব।
সংক্ষিপ্ত বিবরণ:
কাঁঠাল (Artocarpus heterophyllus Lam.) অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভোজ্য ফল (ওজন প্রায় ০.৫-৫০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে) এবং এটি ভারতের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে দরিদ্র মানুষের ফল (poor man’s fruit) হিসেবে পরিচিত। এটি একটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় চিরহরিৎ গাছ এবং ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের পশ্চিমঘাটের বৃষ্টির বনে উৎপন্ন বলে মনে করা হয়। এটি ব্যাপকভাবে চাষ করা হয় মালয়েশিয়া, মায়ানমার, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ব্রাজিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান এবং অন্যান্য গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে।
পুষ্টিগত উপকারিতা:
পুষ্টির পাওয়ার-হাউস বলা হয় কাঁঠালকে। সুস্বাদু কাঁঠালের উপকারিতা জানলে অবাক হবেন। কাঁঠাল কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ এবং ফাইটোকেমিক্যাল সহ পুষ্টিতে সমৃদ্ধ। এটি উচ্চ ধারণ করে কার্বোহাইড্রেটের মাত্রা, প্রোটিন, স্টার্চ, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন, মুক্ত সুগার (সুক্রোজ), ফ্যাটি অ্যাসিড, এলাজিক অ্যাসিড এবং অ্যামিনো অ্যাসিড যেমন আর্জিনাইন, সিস্টাইন, হিস্টিডিন, লিউসিন, লাইসাইন, মেথিওনাইন, থেনাইন এবং ট্রিপটোফান। কাঁঠালের রয়েছে বৈচিত্র্যময় ঔষধিগুণ বিশেষ করে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল, অ্যান্টিক্যানসার এবং ব্যবহার করে অ্যান্টিফাঙ্গাল কার্যকলাপে।
এই অধ্যায়টি কাঁঠালের কার্যকরী, মেডিক্যাল ইননাল, পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যগত দিকগুলির একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ বর্ণনা করে খাদ্য ও পুষ্টি খাতের মধ্যে অগ্রগতির ফলে উন্নয়ন হয়েছে একটি বিশেষ শ্রেণীর খাদ্য, বিশেষত ‘সুপার ফুড’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। সুপার ফুড বিশেষ ধরনের বিভিন্ন অসুস্থতা প্রতিরোধের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ইতিবাচক প্রভাব প্রদর্শন করতে সক্ষম খাবার, ইমিউন সিস্টেমকে শক্তি প্রদান করে এবং প্রয়োজনীয় ম্যাক্রো এবং মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্ট প্রচুর পরিমাণে থাকে।
পশ্চিমবঙ্গে চাষের এলাকা:
পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, বীরভূম, পুরুলিয়া ও গাঙ্গেয় পলিমাটি অঞ্চলে সর্বাধিক চাষ হয়ে থাকে। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুরেও চাষ হয়ে থাকে।
প্রয়োজনীয় আবহাওয়া ও মাটি:
অধিক আর্দ্রতাযুক্ত নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া চাষের পক্ষে উপযুক্ত। উপযুক্ত তাপমাত্রা ২৪- ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নীচে হলে গাছের পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকারক। তুষারপাত বা খুব ঠান্ডা আবহাওয়ায় গাছ ও ফসলের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১৫০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত সহজেই বাড়তে পারে। ২৫০০ মিলিমিটার বার্ষিক বৃষ্টিপাতে এর ফলন ভাল হয়ে থাকে। প্রায় সব রকমের মাটিতেই কাঁঠাল লাগানো যায়। জল দাঁড়ায় না এমন উঁচু ও মাঝারি সুনিষ্কাষিত উর্বর জমি কাঁঠালের জন্য উপযোগী। কাঁঠাল মাঝারি ধরনের ঝড় ও মাটির লবণাক্ত সহ্য করতে পারে।
[আরও পড়ুন: মালদহের বাজার কাঁপাচ্ছে ‘থাই আপেল কুল’, লাভের অঙ্কে মুখে হাসি কৃষকদের]
জাত পরিচিতি:
কাঁঠালের কোনও অনুমোদিত জাত নেই। তবে জাত হিসাবে কাঁঠালকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন- খাজা (Firm flake), গালা বা রসা (Soft flake) ও আদারসা / দো-রসা।। আকার, আকৃতি, স্বাদ এবং ফল ধারনের প্রকৃতি অনুযায়ী কাঁঠালের প্রচুর বৈচিত্র আছে।
গালা বা রসা (Soft flake):
পাকা ফলের ভিতরে সহজেই আঙুল ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। যখন কাঁঠাল ভালভাবে পাকে তখন এর অভ্যন্তরে রক্ষিত কোষ বা কোয়া অত্যন্ত কোমল, মিষ্টি ও রসালো প্রকৃতির হয়ে থাকে। তবে কখনও কখনও রসের স্বাদ টক-মিষ্টিও হয়ে থাকে। কোষ অপেক্ষাকৃত ছোট হয়। খোসার গায়ে কাঁটাগুলো খুব একটা চ্যাপটা হয় না। পাকার পর একটু লালচে-হলুদাভ হয়। কোষগুলোকে সহজেই আলাদা করা যায়।
খাজা (Firm flake):
মিষ্টি, মুচমুচেও স্বাদযুক্ত। কোষ আকারে বড় হয়, পাকার পর কম রসালো ও অপেক্ষাকৃত শক্ত বা কচকচে হয়। কোষ চিপলেও সহজে রস বের হয় না। রং ফ্যাকাশে হলুদ ও স্বাদ মোটামুটি মিষ্টি হয়। সহজে হজম হয় না বলে অনেকেই এ জাতের কাঁঠাল পছন্দ করেন না। খোসার রং পাকার পরও সবুজাভ থাকে এবং গায়ের কাঁটাগুলো মোটামুটি চ্যাপটা। বড় ও মসৃণ প্রকৃতির হয়।