১৪০ কোটির জনসংখার দেশ ভারতবর্ষ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, থেমে নেই। এই দেশ এখন নানা সমস্যার সামনে। খাদ্য সমস্যা, পুষ্টির সমস্যা, বাসস্থান, পানীয় জল, ইত্যাদি। পুষ্টির সমস্যা মেটাতে প্রাণীজ প্রোটিনের চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদার জোগান দিতে প্রাণীজ প্রোটিন যথেষ্ট নয়। সেখানে মৎস্য-প্রোটিন সহজেই প্রাণীজ প্রোটিনের অভাব দূর করতে পারে। পৃথিবীতে মাছ চাষে ভারতবর্ষ দ্বিতীয় স্থানে। ২০১৭-১৮ আর্থিক বছরে ভারতবর্ষ ১২৬০ মেট্রিক টন মাছ উৎপন্ন করে। ১৩.৭৭ লক্ষ টন মাছ বিদেশে রফতানি করে ৪৫,১০৬.৮৯ কোটি টাকা আয় হয়। সরকারি হিসাবে বার্ষিক মাথাপিছু মাছের চাহিদা ১৫ থেকে ২০ কেজি হিসাবে ধরে নিলে ২০৫০ সালে ১২৫ থেকে ২১০ মিলিয়ন টন মাছের উৎপাদন করতে হবে।এই পরিস্থিতিতে জিওল মাছের চাষ একান্তই দরকার।
জিওল মাছ কাকে বলে?
জিওল মাছের শ্বাসতন্ত্রের ফুসফুসে অতিরিক্ত একটি মন্ত্র থাকে। যার সাহায্যে এই মাছেরা বাতাস থেকে সোজাসুজি অক্সিজেন নিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস চালাতে পারে। ফলে, জিওল মাছে জল ছাড়াই অনেক বেশি সময় বাঁচতে পারে। এই মাছের জীবনীশক্তি, অন্যান্য মাছের তুলনায় অনেক বেশি।
জিওল মাছ কোথায় চাষ করা যাবে?
মজা পুকুর, পরিত্যক্ত জলাশয়, ছোট ডোবা, অপরিষ্কার জলাশয়, বর্ষাকালে ধান চাষের জমির জমা জলে, ছোট অগভীর পুকুর, যে সব পুকুরের জল গরমের সময় শুকিয়ে যায় বা যে ডোবা থেকে কোন আয় হয় না বরং অপরিষ্কার জমা জল পরিবেশ দূষিত করে এবং মশা বৃদ্ধি করে, সেই সব জলাশয়ে জিওল মাছের চাষ-খুবই ভাল হয়। মজা পুকুর বা ছায়াযুক্ত ডোবার জলে সাধারণত অক্সিজেনের পরিমাণ কম, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেশি। এইরকম জলে রুই, কাতলা, ইত্যাদি মাছ বাড়ে না। কিন্তু জিওল মাছের অতিরিক্ত শ্বাসযন্ত্র থাকায় পরিত্যক্ত জলাশয়ে জিওল-মাছ চাষের কোনও অসুবিধা হয় না।
[আরও পড়ুন: কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক ‘বঞ্চনা’, গ্ল্যাডিওলাস ফুল চাষে মুখ ফেরাচ্ছেন কৃষকরা]
বড় জলাশয়ে মাছ চাষ
বড় জলাশয়ে যেখানে রুই, কাতলা মাছের চাষ করা হয়, সেখানে বাঁশের বা প্লাস্টিকের খাঁচায় জলের মধ্যে ডুবিয়ে রেখে খাবার দিলে জিওল মাছের চাষ করা সম্ভব। প্রয়োজন মতো খাঁচা থেকে মাছ তুলে বিক্রিও করা যায়।
জিওল মাছ চাষের সময়
আষাঢ় থেকে অশ্বিন মাস। মাগুর, শিঙি, কই এক সঙ্গে মিশ্র পদ্ধতিতে চাষ করলে লাভ বেশি।
জিওল মাছের পোনা
মাগুর বা শিঙির পোনা বিঘা প্রতি ৬-৭ হাজার এবং কই মাছের জন্য৫-৬ হাজার লাগে। পুকুর তৈরির পদ্ধতি:
১) ভরা পুকুর: জলভরা পুকুরে যদি কচুরিপানা থাকে তাহলে তুলে ফেলতে হবে। মহুয়া খোল ছড়ানোর প্রয়োজন নেই। তবে ২ থেকে ৩ বার জাল টেনে পুকুর থেকে সব রাক্ষুসে মাছ, যেমন: শাল, শোল, বোয়াল, ন্যাদোস, ভেটকি, জলজ সাপ তুলে ফেলে জিওল মাছের পোনা ছাড়তে হবে।
২) খালি পুকুর : চৈত্র-বৈশাখ মাসে পুকুর শুকিয়ে সার প্রয়োগ করতে হবে। শতকের হিসাবে, গোবর ২০০ কেজি, সরষের খোল ৮ কেজি, চুন ৬ কেজি, সুপার ফমমেন্ট ৬ কেজি, ইউরিয়া ২ কেজি এবং অনুখাদ্য ৫০০ গ্রাম। সব সার, শুকনো পুকুরের তলদেশে ছড়িয়ে কোদাল বা লাঙল দিয়ে চাষ করতে হয়। তারপর পুকুরে জল ছাড়তে হবে। পনেরো দিন বাদে দেখা যাবে পুকুরের জল হালকা সবুজ হয়েছে। কারণ এই জলে প্রচুর পরিমাণে মাছের খাবার জন্মেছে। যেমন, অ্যালগী, ফাংগী, প্রোটোজোয়া, ব্যাকটেরিয়া, প্রভৃতি। এই পুকুরে এখন মাছের পোনা ছাড়ার উপযুক্ত সময়। কই মাছকে ‘গেছো মাছ’ বলে। তাই পুকুরের চারিদিকে নাইলনের জাল দিয়ে ঘিরে দিতে হবে। বর্ষার সময় ডাঙা দিয়ে যাতে মাছ না পালাতে পারে।
জিওল মাছের খাবার
জিওল মাছ সর্বভুক। জলের তলার পচা পাতা, মরা পোকা, ভাঙ্গা শামুক, গেঁড়ি, গুগলি, শ্যাওলা প্রভৃতি খেতে ভালোবাসে। তাই অনেকে জিওল মাছকে ঝাড়ুদার মাছ বলে। পুকুরের মাঝে একটি বাঁশ পুঁতে রাত্রিবেলায় একটি লণ্ঠন ঝুলিয়ে রাখতে হয়। পতঙ্গ আলোয় আকৃষ্ট হয়ে জলে পড়ে এবং মাছের খাবার হয়। অন্যদিকে ফসলের মাঠেও কীট শত্রুর ক্ষতি কমবে। দ্রুত মাছের বৃদ্ধির জন্য অতিরিক্ত খাবার দিতেও হবে।
খাবার তৈরির পদ্ধতি
শুঁটকি মাছের গুঁড়ো ৩০ ভাগ, সরিষা খোলের গুঁড়ো ১৫ ভাগ, ধানের কুঁড়ো ৫ ভাগ, গমের ভূষি ৫ ভাগ ও ছোলার ছাতু-১৫ ভাগ, গমের আটা ১০ ভাগ, শামুক গুঁড়ো ১৩ ভাগ, ঝোলা গুড় ৫ ভাগ, লবণ ১ ভাগ এবং অনুখাদ্য ১ ভাগ। বড়ি বানিয়ে প্রয়োগ করা হয়।
মাছের ব্যায়াম
সপ্তাহে একবার পুকুরে জাল টানাতে হবে অথবা গরু নামিয়ে সাঁতার কাটাতে হবে। তাহলে মাছেরা দৌড়বে এবং স্বাস্থ্য ও বাড়বে। জিওল মাছ কেন চাষ? তিনটি কারণ।
(ক) পুষ্টিগুণ: জিওল মাছে ম্যাক্রো নিউট্রিয়েন্ট ওমাইক্রো নিউপিয়েন্ট- দুইটিই পাওয়া যায়। এই মাছে কম চর্বি থাকে, প্রোটিন বেশি থাকে (১৮-২০)%। এছাড়া সবরকমের দরকারি ৮টি অ্যামাইনো অ্যাসিডও থাকে। শিশুদের হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক প্রভৃতির গঠনে প্রভূত পরিমাণে সাহায্য করে। বিভিন্ন ধরনের রোগীদের রোগমুক্তিতেও সাহায্য করে। জিওল মাছ খুব পুষ্টিকর এবং খুব সহজেই হজম হয়। এই সব মাছের প্রোটিন ও গ্রহণযোগ্য লোহার পরিমাণ খুব বেশি। জিওল মাছে অতিরিক্ত ঔষধী গুণ থাকায় মাছের বাজারে চাহিদা বেশি, দামও বেশি।
(খ) শ্বাসযন্ত্র: জিওল মাছে অতিরিক্ত শ্বাসযন্ত্রে থাকাতে জল ছাড়া অনেক সময় বাঁচতে পারে। ফলে মাছ সংরক্ষণের জন্য বরফের প্রয়োজন হয় না।
(গ) লাভজনক চাষ: জিওল মাছের চাষ খুব সহজ, লাভজনক আয় ও বেশি। কর্মসংস্থানের প্রচুর সুযোগ। মাছ ধরা:মাগুর মাছ বা শিঙি মাছ ৫-৬ মাসেই পরিণত হয়। তখন ওজন প্রায় ২৫০ গ্রামের মতো হয়। আর কই মাছ ৯-১০ মাসে পরিণত হয় ওজনও প্রায় ১০০ গ্রামের কাছাকাছি। তুলনামূলক ভাবে মাগুর মাছের বৃদ্ধি বেশি ফলনও বেশি। আয়ও বেশি।
জিওল মাছ চাষে আয়
জিওল মাছ অনেকদিন জিইয়ে রাখা যায়। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার খুব সুবিধা। বরফ খরচা নেই। এই মাছ বেশি দামে ও বিক্রি হয়। মাগুর মাছের সঙ্গে শিঙি ও কই মাছ ভালভাবে চাষ করলে ৬ মাস পরে আনুমানিক বিঘা প্রতি ৩,০০০ কেজি মাছের ফলন পাওয়া যায়। খরচ বাদে মোটা টাকা লাভ।