ভারতীয় উপমহাদেশে মার্চ থেকে মে মাস অবধি হিট-ওয়েভ বা তাপপ্রবাহের দাপট দেখা যায়। বিভিন্ন এলাকায়। অত্যধিক গরমে গবাদি পশু-সহ বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে হিটস্ট্রোক, ডায়েরিয়া, ফুড পয়জনিং, ডিহাইড্রেশন, পেশিতে খিঁচুনি প্রভৃতি শারীরিক সমস্যা হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে প্রাণীদের সুস্থ রাখতে পদক্ষেপ জরুরি। লিখেছেন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুবিজ্ঞান বিভাগের গবেষক সুমনকুমার সূত্রধর ও ড. পার্থসারথি চক্রবর্তী। পড়ুন শেষ পর্ব।
পেশিতে খিঁচুনি
গ্রীষ্মকালে প্রাণীর ডিহাইড্রেশন দেখা দিলে বা শরীরে লবণের অভাব দেখা দিলে অনেকসময় বিভিন্ন মাংস পেশি শক্ত হয়ে যায় যাকে পেশির খিঁচুনি বলে। এই খিঁচুনির ফলে প্রাণীটি ওই স্থানে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করে। পা বেঁকে যায়, সোজা করতে পারে না। প্রাণীটির স্বাভাবিক হাঁটাচলা ব্যাহত হয়; প্রাণীটি পা টেনে টেনে চলে।
চিকিৎসা
যত তাড়াতাড়ি পারা যায় প্রাণীর শরীরের জল সঙ্কট দূর করতে হবে। গুড়, নুন-চিনি, ওআরএস, গ্লুকোজ প্রভৃতি বরফ বা ঠাণ্ডা জলে গুলে খাওয়াতে হবে। প্রয়োজনে স্যানাইন দিতে হবে। আক্রান্ত স্থানটি তেল অথবা কোন স্প্রে দিয়ে ভাল ভাবে মালিশ করতে হবে।
ফুডপয়জনিং এবং হজমের সমস্যা
অতিরিক্ত গরমে গুরুপাক খাবার হজম হতে চায় না, ফলে ফুড পয়জনিং বা বদ হজমের মতো রোগ দেখা দেয়। পেটে ব্যথা ও বমি হতে পারে। পেটের যন্ত্রণার ফলে প্রাণীটির অস্থির ভাব লক্ষ্য করা যায়। অনেকসময় পেট ফুলে যেতে পারে।
চিকিৎসা
উচ্চ প্রোটিন যুক্ত খাবার বর্জন করাই শ্রেয়। পোষ্যর ক্ষেত্রে বেশি মশলাদার খাবার খাওয়ানো চলবে না। বমির ওষুধের সাথে স্যালাইন দিতে হতে পারে। তাছাড়া হজমের ওষুধের সাথে লিভার টনিক খাওয়াতে হবে।
নাক দিয়ে রক্ত পড়া
নাক দিয়ে রক্ত পড়াকে বলে এপিস্ট্যাক্সিস। গ্রীষ্মকালে অত্যধিক গরমের প্রভাবে অথবা হঠাৎ আবহাওয়ার পরিবর্তন হলে, কখনও প্রাণীর নাক দিয়ে রক্ত পড়তে দেখা যায়।
চিকিৎসা
প্রথমেই প্রাথমিক চিকিৎসা হিসাবে নাকের উপর ও চারপাশে বরফ ঘষতে হবে। যদি সম্ভব হয় বরফ-জলে গজ ভিজিয়ে নাকের ভেতর প্যাক করে দিতে হবে; তবে তা ২৪ ঘণ্টার বেশি রাখা যাবে না। রক্তক্ষরণ বন্ধের জন্য এপিনেফ্রিন সলিউশন নাসারন্ধ্রে ফোঁটা ফোঁটা করে লাগালে উপকার পাওয়া যায়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে ক্যালসিয়াম বোরোগ্লুকোনেট, ভিটামিন-কে এবং ডিএনএস স্যালাইন সরাসরি শিরায় দিতে হবে।
[আরও পড়ুন: তীব্র গরমে মারত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত উত্তরের চাষের মাঠ, লক্ষাধিক চাষির মাথায় হাত]
মূত্রনালির সংক্রমণ
অতিরিক্ত গরমে যদি প্রাণী জল কম পান করে তাহলে অনেকসময় মূত্রনালীতে সংক্রমণ দেখা দেয়। বারবার প্রস্রাব করার চেষ্টা করে। অনেকসময় প্রস্রাব বের হয় না অথবা ফোঁটা কেটে কেটে প্রস্রাব পড়ে। প্রস্রাব গাঢ় হলুদ বর্ণের হয়। কখনও প্রস্রাবের সাথে রক্তও আসতে পারে। পিছনের পা ফুলতে পারে। পেটে মাঝে মাঝে যন্ত্রণা হতে থাকে। অনেকসময় বমিও হতে পারে।
চিকিৎসা
ডাইইউরেটিক যেমন অ্যাল্কাসল, অ্যাল্কাভেট বা অ্যাঙ্কারল প্রভৃতি দিনে তিন বার খাওয়াতে হবে। ডি.এন.এস (DNS) স্যালাইন দিতে হবে। বেশি করে ঠাণ্ডা জল পান করাতে হবে। প্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করতে হবে। তবে তা অবশ্যই প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে।
পা পুড়ে যাওয়া
খুরযুক্ত প্রাণীদের এই রোগটি দেখা যায় না। এটি কেবলমাত্র থাবা আছে এমন প্রাণীদের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। অতিরিক্ত গরমে রাস্তাঘাটের পিচ, বালি, মাটি সব গরম হয়ে থাকে। নরম থাবা নিয়ে ওই গরমে পা দিলেই পা পুড়ে যায় বা ফোস্কা পড়ে যায় বা থাবা লাল হয়ে যায়। বিশেষ করে পোষ্যদের এই রোগটি হয়ে থাকে।চিকিৎসা:বাড়ির পোষ্যকে দুপুরের রোদে বাইরে না নিয়ে যাওয়াই ভাল। একান্তই যদি নিয়ে যেতে হয় তাহলে খেয়াল রাখতে হবে যাতে পোষ্যটি ঘাসে পা দিয়ে চলে। না হলে পায়ে মোজা বা জুতোর ব্যবস্থা করতে হবে। বাইরে থেকে ফেরার পরেই ঠাণ্ডা জল দিয়ে পা ধুইয়ে দিতে হবে। যদি দুর্ভাগ্যবশত পায়ে ফোস্কা পড়ে যায় তাহলে পায়ে বরফ লাগাতে হবে। প্রয়োজনে মলমও লাগানো যেতে পারে।
উপসংহার
প্রাণীদের মধ্যে তাপ চাপ (Heat Stress) একটি উল্লেখযোগ্য উদ্বেগ যা পশুস্বাস্থ্য, কল্যাণ এবং উৎপাদনশীলতার জন্য গুরুতর পরিণতি হতে পারে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রাণীদের মধ্যে তাপের চাপের ঝুঁকিও বৃদ্ধিপায়, যা কৃষক, পশুপালক এবং পোষা প্রাণীর মালিকদের এই প্রভাব গুলি প্রশমিত করার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণে অপরিহার্য করে তোলে। পর্যাপ্ত ছায়া, জল এবং বায়ুচলাচল প্রদানের মতো কৌশল গুলি প্রাণীদের জন্য একটি আরামদায়ক পরিবেশ বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে। তাপের চাপের লক্ষণ গুলির জন্য পর্যবেক্ষণ করা এবং শীতল করার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যাগুলিও প্রতিরোধ করতে পারে। গরম আবহাওয়ায় প্রাণীদের চাহিদার প্রতি সজাগ এবং প্রতিক্রিয়াশীল হওয়ার মাধ্যমে, আমরা তাদের সুস্থতা এবং উৎপাদন শীলতা নিশ্চিত করতে পারি। সার্বিকভাবে বিশ্ব উষ্ণায়ন রোধ করতে না পারলে সমগ্র জীবকূলের রেহাই নেই। সভ্যতার বর্বরতা এইরকম চলতে থাকলে, উষ্ণতার পারদ বাড়তে বাড়তে সারা পৃথিবীই একদিন ঝলসে যাবে। নিজেদের অসাবধানতা ও সাময়িক সুখের কারণে সমগ্র পৃথিবীকেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছি আমরা। তাই সকলের কাছে বিনীত নিবেদেন এই যে 'গাছ লাগান প্রাণ বাঁচান-পৃথিবী বাঁচান'।