বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: উত্তরেও ক্রমশ বাড়ছে দহনজ্বালা। প্রখর গরমে পুড়ছে হেক্টরের পর হেক্টর চা বাগান। জলসেচ দিয়েও শেষরক্ষা সম্ভব হচ্ছে না। তার উপর দোসর হয়েছে রেড স্পাইডার, লুপারের মতো সবুজ খেকো পোকার হামলা। মাটি শুকিয়ে গাছ নুইয়ে পড়েছে। এমন দুর্যোগ দেড় দশকে দেখা যায়নি বলে চা উৎপাদকদের একাংশের দাবি। ওই পরিস্থিতিতে বড় চা বাগানের পাশাপাশি দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন উত্তর দিনাজপুর, তরাই, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহার জেলার অন্তত পঞ্চাশ হাজার ক্ষুদ্র চা চাষিরা। পাতার অভাবে এখনও খোলেনি অর্ধেক বটলিফ কারখানা। যে কয়েকটি কারখানা চলছে সেগুলোও পর্যাপ্ত কাচা পাতা না পেয়ে বন্ধ হওয়ার পথে।
কতদিন থেকে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি নেই। উধাও কালবৈশাখী। উত্তরের সমতলের চা বলয়ে ইতিমধ্যে তাপমাত্রার পারদ ৩৬ ডিগ্রি থেকে প্রায় ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। সঙ্গে আগুনের হলকার মতো বইছে শুষ্ক দমকা হাওয়া। চা গবেষণা কেন্দ্রের গবেষক তৃণা মন্ডল জানিয়েছেন, ভালো চা পাতা উৎপাদনের জন্য ৩১ ডিগ্রি থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে তাপমাত্রা, দিনে রোদ এবং রাতে বৃষ্টি দরকার। এবার কোনওটাই নেই। উলটে ১৬ এপ্রিল থেকে একাধারে লাফিয়ে তাপমাত্রার পারদ চড়ছে। অসহ্য গুমোট গরমে মাটি শুকিয়ে ধুলো উড়ছে। অতিগরমে চা গাছের পাতা ঝলসে বাদামী হয়ে গিয়ে নষ্ট হচ্ছে।
[আরও পড়ুন: নগরায়ণের ধাক্কায় জমির অভাব? ব্যালকনিতেই করুন ‘বিষ’মুক্ত সবজি চাষ]
পাশাপাশি তাপমাত্রা বাড়তে লুপার, লাল পোকা, গ্রিন ফ্লাই অর্থাৎ সবুজ মাছি, মশার উপদ্রব বেড়েছে। বলে রাখা ভালো, লুপারকে রাক্ষুসে সবুজখেকো পোকাও বলা হয়। এটা সবুজ চা পাতা চিবিয়ে খেয়ে শেষ করছে। লাল পোকা শুষে নিচ্ছে গাছের ডগার রস। কার্যত উভয় সঙ্কটে পড়ে দিশাহারা চা উৎপাদকরা। তাদের বড় অংশ সেকেন্ড ফ্ল্যাসের পাতা তোলার আশা ছেড়ে কোনও মতে গাছ বাঁচানোর লড়াই শুরু করেছেন।
এনিয়ে কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান স্মল টি গ্রোয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বিজয়গোপাল চক্রবর্তী বলেন, "বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। গত দেড় দশকে এমন আবহাওয়া দেখিনি। দিনরাত সেচের ব্যবস্থা করেও গাছ বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।" যদিও খরচের জন্য প্রত্যেকে যে পর্যাপ্ত সেচের ব্যবস্থা করতে পারছেন এমন নয়। সাধারণ সময়ে চা গাছ রক্ষা করতে মাসে দুবার সেচ দিতে হয়। এক একর আয়তনের চা বাগানে সেচ দিতে মাসে খরচ হয় ৪০ হাজার টাকা। এখন দিনরাত সেচ চলছে। সব চাষিদের পক্ষে ওই ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। টানাটানির সংসারে মাথায় হাত পড়েছে ওই ক্ষুদ্র চা চাষিদের। তারা জানান, তাপমাত্রা না নামলে বাগান রক্ষা করা সম্ভব হবে না।" কিন্তু কতদিনে তাপমাত্রা নামবে এমন ইঙ্গিত আবহাওয়া দপ্তরের কর্তারাও দিতে পারছেন না।
[আরও পড়ুন: কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে পেঁচাই কৃষকের ভরসা, কীভাবে?]
ক্ষুদ্র চা চাষি সংগঠন সূত্রে জানা গিয়েছে, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর জেলা এবং শিলিগুড়ি মহকুমায় ৫০ হাজারের বেশি ছোট চা বাগান রয়েছে। সেখান থেকে বছরে গড়ে ১ হাজার ২৫০ মিলিয়ন কেজি কাচা চা পাতা উৎপাদন হয়। ওই বাগানগুলোতে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ। চা পাতা উৎপাদন কমে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দেওয়ায় তাদের অনেকেরই দৈনিক রোজগার অনিশ্চিত হয়েছে। জলপাইগুড়ি জেলা ক্ষুদ্র চা চাষি সংগঠনের অন্যতম কর্তা রজত কার্জি বলেন, "চায়ের সেকেন্ড ফ্লাস শুরু হয়েছে। কিন্তু যেভাবে তাপমাত্রা বাড়ছে, পোকার আক্রমণ শুরু হয়েছে পাতা মিলবে না। আরও কয়েকদিন এই পরিস্থিতি চললে বাগান রক্ষা করা যাবে না।"