সয়াবিন বীজ কাঁচা, শুষ্ক অবস্থায় বা অঙ্কুরিত অবস্থায় খাওয়া যায়। সয়াবিন ময়দা থেকে কেক, রুটি, বিস্কুট প্রভৃতি খাবার বানানো যায়। সয়াবিন তেল রান্নার কাজে, স্যালাড তেল ও মার্জারিন তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। আরও বহুবিধ কাজে সয়াবিন তেল ব্যবহৃত হয়। সয়া মিল্ক, সয়া-পনির, সয়া-সস ও সয়া-ময়দা প্রভৃতি প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্য সয়াবিন বীজ থেকে তৈরি হয়। সয়াবিন চাষ করে কৃষকের শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে বাজারে ভাল দাম থাকায়। লিখেছেন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শস্যবিজ্ঞান বিভাগের গবেষক ওসমান আলি।
সয়াবিন [Soybean-Glycine max (L.), Merr. Leguminosae] পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিম্বগোত্রীয় তৈলবীজ। ভারতবর্ষে চিনাবাদাম ও রাই সর্ষের পরে সয়াবিন তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ তৈলবীজ। এটি হিন্দিতে ভাট বা রামকুর্থী নামে পরিচিত। সয়াবিনের অপর বৈজ্ঞানিক নাম গ্লাইসিন সোজা [Glycine soja (L.) Sieb & Zucc] বা সোজা ম্যাক্স [Soja max (L.) Piper] বা গ্লাইসিন হিসপিডা [Glycine hispida (Moench) Maxim]। সয়াবিনকে ‘বিস্ময়কর বিন’ ও বলা হয়।
পুষ্টিমূল্য
সয়াবিনে আমিষের পরিমাণ অন্য যে কোনও খাদ্যশস্যর থেকে বেশি থাকে। ডাল জাতীয় অন্যান্য ফসল থেকেও এর পুষ্টিমান দ্বিগুণ এবং বাজারে সবচেয়ে সস্তা, খেশারী ডালের দামের অর্ধেক। তেল সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে সয়াবিন ক্যালোরি ঘাটতি মেটাতে সক্ষম। পশ্চিমবঙ্গের আবহাওয়া এবং পরিবেশ সয়াবিন চাষের জন্য উপযোগী। সয়াবিনের ভাজা ডাল এবং খিচুরী অত্যন্ত পুষ্টিকর, সুস্বাদু ও রুচিকর। সয়াবিন মূলত প্রোটিন ও তেলের উৎস হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সয়াবিনে প্রায় ২০ শতাংশ তেল ও ৪০-৪২ শতাংশ উন্নতমানের প্রোটিন উপস্থিত থাকে। সয়াবিন তেলের মধ্যে প্রধানত অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড এবং প্রধান অ্যামাইনো অ্যাসিড হিসাবে লাইসিন থাকে। তবে সয়াবীন বীজের মধ্যে পরিপাক পরিপন্থী পদার্থ হিসাবে ট্রিপসিন ইনহিবিটর, হেমাগ্লুটিনিন ও ওলিগোস্যাকারাইড বর্তমান।
ব্যবহার
সয়াবিন প্রোটিন ও তেলের উৎস হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সয়াবিন তেল রান্নার কাজে, স্যালাড তেল ও মার্জারিন তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ফ্রোজেন ডেসার্ট, কুকি শর্টনিং, কনফেকশাস আইসিং, আইসক্রিম কোটিং, হুইপড টপিং ও কফি হোয়াইটনার তৈরিতে সয়াবীন তেল ব্যবহৃত হয়। সয়াবিন তেল সাবান, রঙ, রেসিন, গ্লিসারিন, ছাপার কালি, গ্রাজ, বার্নিশ, ড্রাই তেল শিল্পে ব্যবহৃত হয়। সয়া মিল্ক, সয়া-পনির, সয়া-সস ও সরা-ময়দা প্রভৃতি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য সয়াবিন বীজ থেকে তৈরি হয়। সয়াবিন তেল উৎপাদনের সময় উপজাত হিসাবে উৎপাদিত ‘সয়া-লেকিথেন’ খাদ্য শিল্পে কোমলকারক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সয়া-খোল বা সয়ামিল পশু-পাখির খাদ্য। সয়াবীন খোলে ৭ থেকে ৮.৪৮ শতাংশ নাইট্রোজেন, ০.৭২ শতাংশ ফসফেট ও ২.১ শতাংশ পটাশ বর্তমান। সয়াবীন খোলে ৩৮-৪০ শতাংশ প্রোটিন থাকে। সবুজ গাছ পশুখাদ্য হিসাবে এবং সয়াবিন সবুজ সার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সয়াবিন বীজ কাঁচা, শুষ্ক অবস্থায় বা অঙ্কুরিত অবস্থায় খাওয়া যায়। সয়াবিন ময়দা থেকে কেক, রুটি, বিস্কুট প্রভৃতি খাবার বানানো যায়।
[আরও পড়ুন: বাড়ির টবেই ফলান মিশরীয় ডুমুর, জেনে নিন পদ্ধতি]
এলাকা
পৃথিবীর প্রধান ১০টি সয়াবিন উৎপাদক দেশ হল, আমেরিকা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ভারত, চিন, প্যারাগুয়ে, কানাডা, বলিভিয়া, উরুগুয়ে ও ইন্দোনেশিয়া। ভারতের প্রধান প্রধান সয়াবীন উৎপাদক রাজ্যগুলি হল, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, অন্ধ্রপ্রদেশ ও কর্নাটক। পশ্চিমবঙ্গের প্রধান সয়াবিন উৎপাদক জেলা হল দার্জিলিং। এছাড়া বর্ধমান ও বীরভূম জেলায় কিছু এলাকায় চাষ হয়। ২০১১-১২ সালে পশ্চিমবঙ্গে ৫৮১ হেক্টর এলাকায় ৮১৬ কেজি/হেক্টর উৎপাদন হারে মোট ৪৭৪ টন সয়াবিন উৎপন্ন হয়েছে। সেখানে ২০১৯-২০ সালে পশ্চিমবঙ্গে ২৪৯ হেক্টর এলাকায় ৭৭৯ কেজি/হেক্টর উৎপাদন হারে মোট ১৯৪ টন সয়াবিন উৎপন্ন হয়েছে। এবং ২০২১-২২ সালে পশ্চিমবঙ্গে ২৪৪ হেক্টর এলাকায় ৮৪৮ কেজি/হেক্টর উৎপাদন হারে মোট ২০৭ টন সয়াবিন উৎপন্ন হয়েছে।
শস্য পর্যায়
সয়াবিন বর্ষাকালীন ও শীতকালীন ফসল হিসাবে চাষ করা হয়। একক বা সাথী ফসল হিসাবে লাগানো যায়।
মাটি ও আবহাওয়া
সয়াবিন বিভিন্ন মাটি ও আবহাওয়ায় জন্মাতে পারে। তবে জলনিকাশি ব্যবস্থাযুক্ত বেলে-দোঁয়াশ ও এঁটেল-দোয়াঁশ মাটি বেশি উপযোগী। মাটির জলধারণ ক্ষমতা একটু বেশি হওয়া প্রয়োজন। সয়াবিন আলোকসংবেদনশীল ফসল। সয়াবিন দ্রুত অঙ্কুরোদগমের জন্য প্রায় ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়।
জাত
পশ্চিমবঙ্গের চাষের উপযোগী সয়াবিনের কয়েকটি জাত হল-পিকে-৪৭২, জেএস ৯৭-৫২, জেএস-৮০-২১, সমরুধী। নীচে কয়েকটির বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হল।
বোনার সময়
পশ্চিমবঙ্গে বছরে দুইবার সয়াবিন লাগনো যাবে। বর্ষাকালীন ফসল। হিসাবে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে (জুন-জুলাই) এবং শীতকালীন ফসল হিসাবে অগ্রহায়ণ মাসে (মধ্য নভেম্বর থেকে মধ্য ডিসেম্বর) বীজ লাগানো হয়।
বীজের হার
সারিতে বীজ বপন করলে এক একর জমিতে ২২ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়ে থাকে। আর ছিটিয়ে বীজ বপন করলে এক একর জমিতে ২৮ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়ে থাকে।
বীজ শোধন ও জীবাণু প্রয়োগ
প্রতি কেজি বীজের সঙ্গে ২ গ্রাম কার্বেন্ডাজিম বা ৩ গ্রাম ম্যানকোজেব মিশিয়ে বীজশোধন করা হয়। নতুন জমিতে বা দুই বছর সয়াবিন চাষ হয়নি এমন জমিতে চাষের জন্য একর প্রতি প্রয়োজনীয় বীজের সঙ্গে ৬০০ গ্রাম রাইজোবিয়াম কালচার মেশানো হয়। বীজ শোধনের ওষুধ রাইজোবিয়াম জীবাণুর পক্ষে ক্ষতিকর। এজন্য বীজ বোনার ১ সপ্তাহ আগে বীজশোধন করে রেখে তারপর রাইজোবিয়াম মিশিয়ে জমিতে লাগানো হয়। বীজের সঙ্গে রাইজোবিয়াম কালচার মেশানোর জন্য ২-৩ লিটার জলে ৫০০ গ্রাম গুড় মিশিয়ে আধ ঘণ্টা ফুটিয়ে ঠান্ডা করা হয়। ওই মিশ্রণে এক একর জমির বীজ মিশিয়ে ছায়ায় শুকানোর পর বোনা হয়। ভাতের ঠান্ডা ফ্যান গুড়ের পরিবর্তে ব্যবহার করা যেতে পারে।
জমি তৈরি ও বীজ বোনা
জমি ভাল ভাবে চাষ ও মই দিয়ে তৈরি করে নিতে হবে। মাটির ধরন বুঝে জমি চাষ দিতে হবে। ৪-৫ টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। মাটি ঝুরঝুরে করে দিতে হবে এবং জমি ভালভাবে আগাছা মুক্ত করে নিতে হবে। তারপর মাদা তৈরি করতে হবে যেন জমিতে সেচ দিতে বা গাছের পরিচর্যা করতে সুবিধা হয়। এ সময়ে মাটিতে ২০ কুইন্ট্যাল কম্পোষ্ট সার একর প্রতি মেশানো উচিত। একর প্রতি ২০ কেজি বীজ ছিটিয়ে কিংবা সারিতে বোনা হয়। বীজ ছিটানোর পর মাটির মধ্যে বীজ ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য ভালভাবে মই দেওয়া হয়।
বোনার দূরত্ব
সয়াবিন বীজ জমিতে ছিটিয়ে বপন করা যায়। আবার সারিতে ও বপন করা যায়। তবে বীজ সারিতে বপন করা সবচেয়ে ভালে। সারিতে বপন করলে বর্ষাকালীন ফসলের জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব ৪৫ সেমি এবং সারিতে গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ১৫ সেমি। শীতকালীন ফসলের জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেমি এবং সারিতে গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ১৫ সেমি। ৩-৪ সেমি গভীর করে বীজ বপন করতে হবে। আর যদি ছিটিয়ে বপন করা হয় তবে বীজ বপন করার পর জমিতে মই দিয়ে বীজ মাটির সাথে ভাল ভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
সার প্রয়োগ
জমি তৈরির সময় একর প্রতি ২০ কুইন্ট্যাল কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করা হয়। অম্ল মাটিতে বীজ বোনার কম বা বেশি ৩ সপ্তাহ আগে একর প্রতি ৪-৮ কুইন্ট্যাল ডলোমাইট প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
রাসায়নিক সার প্রয়োগের সুপারিশ মাত্রা হল একর প্রতি ৮ কেজি নাইট্রোজেন, ২৪ কেজি ফসফেট ও ২৪ কেজি পটাশ, যা মূলসার হিসাবে প্রয়োগ করতে হয়। এজন্য একর প্রতি ১৭.৫ কেজি ইউরিয়া (বা ৩২ কেজি ক্যান বা ৪০ কেজি অ্যামোনিয়াম সালফেট), ১৫০ কেজি সিঙ্গল সুপার ফসফেট ও ৪০ কেজি মিউরেট অফ পটাশ মূলসার হিসাবে লাগবে। ফসলের সালফার চাহিদা মেটাতে একর প্রতি ৮ কেজি সালফার প্রয়োগ করতে হয়। ফসফেট সার হিসাবে সিঙ্গল সুপার ফসফেট প্রয়োগ করলে আলাদাভাবে সালফার প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। বোরন ঘাটতিযুক্ত এলাকায় একর প্রতি ৪ কেজি বোরাক্স জৈবসারের সঙ্গে মিশিয়ে মূলসার হিসাবে প্রয়োগ করা হয়। তরাই, লালমাটি ও বিন্ধ্য পলিমাটি এলাকায় মলিবডেনামের ঘাটতি মেটাতে একর প্রতি ২০০ গ্রাম অ্যামোনিয়াম মলিবডেট মূলসার হিসাবে প্রয়োগ করা উচিত।
অন্তর্বর্তী পরিচর্যা
বীজ বোনার ৩ সপ্তাহের মধ্যে আগাছা ও ঘন গাছ তুলে পাতলা করে দেওয়া হয়। প্রতি বর্গ মিটারে ৩৫-৪০টি গাছ রাখা হয়। প্রয়োজনে বীজ বোনার ৬ সপ্তাহ পরে একবার হাত নিড়ান দেওয়া প্রয়োজন হয়। রাসায়নিক আগাছানাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হলে বীজ বোনার আগে ৯০০ মিলি ফ্লুক্লোরালিন ৪৫% কিংবা বোনার ১-২ দিনের মধ্যে ৫৭৫ গ্রাম মেট্রিবুজিন ৭০%এ বা ৬০০ মিলি ইমাজেথাপায়ার ১০% কিংবা বোনার ১০-১৫ দিন পর ৪০০ মিলি কুইজ্যালোফপ ইথাইল ৫% বা ১৫ গ্রাম ক্লোরমিউরন ইথাইল ২৫% ২০০-২৫০ লিটার জলে গুলে একর প্রতি প্রয়োগ করা হয়।
জলসেচ
সয়াবিন চাষে ২০-২৫ সেমি জলের প্রয়োজন। প্রাথমিক বাড়ন্ত দশায় অর্থাৎ বোনার ৩৫ দিন পর একটি এবং ফুল আসার পর কমপক্ষে ২টি সেচের প্রয়োজন। ফুল আসার পর ১০দিন অন্তর সেচের সুযোগ থাকলে দেওয়া যাবে।
ফসল তোলা ও ফলন
শুঁটির রঙ সোনালি হলুদ, কালচে বা ধূসর হলে পাকার উপযোগী হয়। কাস্তে দিয়ে মাটির লেভেল বরাবর গাছ কাটা হয়। মেঝেতে শুকিয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে দানা আলাদা করা হয়। কাটার সময় ১৫-১৭ শতাংশ জলীয় অংশ থাকে। সেচ সেবিত স্থানে একর প্রতি ৮০০-১০০০ কেজি ফলন পাওয়া যায়।