স্বাদ বদলের ছোট্ট ছুটিতে হাতছানি দেয় অরণ্যবেষ্টিত এই ঐতিহাসিক শহর। যার পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে রোমান্টিক ‘ডুলুং’। ভ্রমণ আড্ডায় ঝাড়গ্রাম। ঘুরে এলেন অমর নন্দী।
অরণ্য ঘিরে রেখেছে এক শহরকে। কোথাও কোথাও শহর-অরণ্য একাকার। শাল, পলাশ, মহুয়া আর কেন্দু। ঘরের কাছেই হাওড়া থেকে মাত্র দু’-ঘণ্টার ট্রেন জার্নিতে পৌঁছনো যায় ঝাড়গ্রামে। আর এই শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে এক নদী। নামটি বড় রোমান্টিক। ডুলুং।
হাওড়া থেকে ইস্পাত এক্সপ্রেসে সকাল ন’টার কিছু পরই নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। অটোতে পনেরো মিনিটেই আমাদের গেস্ট হাউস। নতুন বাসস্ট্যান্ডের কাছে। কলকাতার যানজট আর দূষণ থেকে ছুটি নিয়ে স্বাদ বদলাতে অরণ্যবেষ্টিত এই ঐতিহাসিক শহরে আসা।
[ আরও পড়ুন: ‘কাশ্মীর আসুন’, পর্যটকদের ভূস্বর্গ ভ্রমণের আবেদন ‘দিলবরো’ খ্যাত বিভার ]
মল্লদেব রাজাদের রাজবাড়ি ও সাবিত্রী মন্দির
গেস্ট হাউসে দুপুরে লাঞ্চের পর সামান্য বিশ্রাম নিয়ে বেরোলাম ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ির উদ্দেশে। মল্লদেব রাজাদের স্মৃতিবিজড়িত এই রাজবাড়ি। শাল, মহুল, পিয়ালের মধ্যে দিয়ে আমাদের গাড়ি এখন রাজবাড়ির উদ্দেশে। পথে জঙ্গলাকীর্ণ উঁচু প্রাচীর ঘেরা অতীতের ধূসর স্মৃতি সর্বাঙ্গে মাখা ভাঙা বিশাল ইমারত দেখিয়ে আমার যাত্রাসঙ্গী স্থানীয় শিক্ষক সুশান্তবাবু বললেন, ‘এটা পুরনো রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ।’ মূলত পাইক, চুয়াড় সম্প্রদায়ের বাস ছিল জঙ্গলাকীর্ণ এই ঝাড়গ্রামে। দস্যুবৃত্তিই ছিল তাদের প্রধান জীবিকা। কথিত আছে, শ্রীক্ষেত্র থেকে একদল পুণ্যার্থী ফিরে আসার সময়, সেই দলের এক কন্যা সাবিত্রীকে তারা হরণ করে। ক্রমে তার রূপে মুগ্ধ এক দস্যুপুত্র সাবিত্রীকে পেতে চাইলে দৈব প্রেরিত এক খড়গের সাহায্যে তিনি আত্মরক্ষা করেন। তার পরবর্তী সময়ে দস্যুদের হটিয়ে আজকের মল্লদেব রাজপরিবার দখল নেয় ঝাড়গ্রামের। তখন স্বয়ং রাজা সাবিত্রীকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। বিয়ের দিন সাবিত্রী নিরাভরণ হয়ে শাল, পিয়ালের বনের দিকে ছুটে চললেন। তখন হঠাৎ আসা এক ঝড়ে সাবিত্রী তলিয়ে যান বালির তরঙ্গে। রাজা তাঁর অনুসরণ করে ধরতে গেলে সংজ্ঞা হারান সেই আঁধিতে। সম্বিত ফিরলে দেখেন তাঁর হাতে সাবিত্রীর কেশগুচ্ছ ধরা। পরে স্বপ্নাদেশে রাজা পাশেই মানবীদেবী সাবিত্রীর বিগ্রহহীন মন্দির স্থাপন করেন। সেখানে রাখা আছে ‘দৈব প্রেরিত’ খড়গ আর সাবিত্রীর কেশগুচ্ছ।
প্রচলিত এই কাহিনি শুনতে শুনতে প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচু রাজবাড়ির মূল ফটক পেরিয়ে ঢুকলাম রাজবাড়ির চৌহদ্দিতে। সামনেই সাজানো ফুলের বাগান। পিছনে পূর্বমুখী বিশাল ঘিয়ে রঙের রাজবাড়িটি অপূর্ব কারুকার্য খচিত। ঢুকতেই বাঁদিকে রয়েছে অতিথিশালা এই বংশের শেষ রাজা নরসিংহ মল্লদেব। তাঁর নামেই সামনের রাস্তার নামকরণ। এই রাজবাড়িতে এখনও থাকেন তাঁর উত্তরসূরী শিবেন্দ্রবিজয় মল্লদেব, জয়দীপ মল্লদেব ও তাঁদের পরিবার। হিন্দু ধর্মমতে সমস্ত উৎসব যেমন দুর্গাপুজো, দোল, রথযাত্রা, জন্মাষ্টমী এখনও এখানে জাঁকজমকভাবে হয়। বর্তমানে সংস্কারের পর রাধাকৃষ্ণ মন্দির ও শিবমন্দির নতুনভাবে তৈরি হয়েছে।
অনতিদূরেই রয়েছে সাবিত্রী মন্দির। পাঁচটি গোলাকৃতি খিলান গাঁথনিযুক্ত চারপাশে বারান্দা। সম্পূর্ণ বেলেপাথরের ব্লক দিয়ে তৈরি এই মন্দিরের শীর্ষটি প্রায় পঞ্চাশ ফুট উঠে গিয়েছে। নিত্য পুজো হয় এই মন্দিরে।
কণকদুর্গা মন্দির, শাল-পলাশের বন আর ডুলুং
পরদিন যাত্রা শুরু একটু সকাল সকাল। শহরপ্রান্তে ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজ পেরিয়ে দুবরাজপুর মোড় থেকে ডানদিকে গিধনি রোড ধরলাম। শহর ছাড়তেই শাল, পিয়াল, মহুয়ার এক সবুজ আমন্ত্রণে ভেসে চলতে লাগলাম। পথের দু’ধারে সারি সারি শালের বন। তাতে মঞ্জরি ছেয়ে আছে। কোথাও কোথাও মহুয়া আর পলাশ উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। মাঝখানে কালো মসৃণ রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে চোখ দুটোকে সকালের হিমেল হাওয়ার সঙ্গে এক নরম অনুভূতিতে ভরে দিচ্ছে। আমাদের গন্তব্য এবার কণকদুর্গার মন্দির। কিছুদূর গিয়ে গাড়ি ডানদিকে ঘুরল। এগিয়ে গিয়ে একটি তোরণ। তার পাশে গাড়ি পার্ক করার একটি নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি রেখে মন্দিরের দিকে এগোতে হবে। গভীর জঙ্গল ভেদ করে ডুলুং নদীর পাড়ে এই কণকদুর্গার মন্দির। অতীতে লাল মোরামের পথ ছিল।
বর্তমানে বাঁধানো রাস্তা। কুচিলা (নাক্সভোমিকা), কেন্দু, বাদাম, শাল আর মুচকুন্দের গা ছমছমে গভীর জঙ্গল দু’ধারে। এই ঘন সবুজ অরণ্যের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে এক অন্যরকম রোমাঞ্চে আবিষ্ট হতে হয়। অনেকটা পথ এইভাবে পার হয়ে দেখা মেলে একটি খোলা চত্বরের। তার এক কোণে জঙ্গলের পাশে অতীতের কণকদুর্গার ভগ্নপ্রায় পঞ্চরত্ন মন্দিরটি কালের সাক্ষী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে। ১৩৪৮ সালে নতুন মন্দির স্থাপন হয়। মন্দিরের ভিতরে বিরাজমান অষ্টধাতুর চতুর্ভুজা-ত্রিনয়নী কণকদুর্গা। কথিত আছে, অতীতে প্রতি অমাবস্যায় নরবলি হত। বর্তমানে নবমীতে ছাগবলির রীতি আছে। মন্দিরের পাশ দিয়ে গভীর অরণে্যর সুঁড়ি পথ নেমে গিয়েছে ডুলুং নদীর পাড়ে। নদী এখন নিস্তরঙ্গ। বর্ষায় দু’কূল ছাপিয়ে জল বয়ে যায়। নদীর মাঝে ইতস্তত বড় বড় পাথর। কোথাও গ্রামের ছেলেমেয়েরা স্নাতরত। গভীর অরণ্য এঁকেবেঁকে হারিয়ে যাওয়া ডুলুংয়ের পাড়ে মৌনমুনির মতো মাছ শিকারের আশায় ধ্যানরত কিছু সাদা বক। দূরে একঝাঁক নাম না-জানা পাখি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে নিঃসীম নীলাকাশে পাখা মেলল। একরাশ সুগন্ধী স্মৃতি নিয়ে আমাদেরও ফিরে চলা এবার।
[ আরও পড়ুন: চেরাপুঞ্জির এই ঝরনার নামকরণের ইতিহাস জানলে চোখে জল আসবে পর্যটকদের ]
কীভাবে যাবেন
হাওড়া থেকে ইস্পাত, স্টিল এক্সপ্রেস, ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব রেলের হাওড়া কোরাপুট এক্সপ্রেসে আড়াই ঘণ্টায় ঝাড়গ্রাম পৌঁছনো যায়। এছাড়া খড়্গপুর থেকে লোকাল ট্রেনেও ঝাড়গ্রাম যাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন
ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ির ‘দ্য প্যালেস’ রিসর্টে থাকা যায়। (ফোন নং 6294024319, 9635269416) Email-jhargram pace@gmail.com. এছাড়া ডুলুং গেস্ট হাউস (ফোন নং 255909), রেণু লজ (ফোন : 255274) প্রভৃতি।
The post অরণ্যের মাঝেই রাজবাড়ি, ইতিহাস বুকে নিয়ে অপেক্ষায় ডুলুং নদীর পাড় appeared first on Sangbad Pratidin.