রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: ভীষণ সত্য। অনিবার্য বাস্তব। অসহনীয় সুন্দর। ক্লিশেক্লান্ত নয় এতটুকু। বাণিজ্যিক আপসের বাইরে সাহসী পা ফেলে আসতে ‘দেরি হয়ে গেছে’র দেরি কিন্তু হয়নি। ঠিক সময়ে এসেছে। কিছু বাঙালি দর্শক অন্তত অক্লান্ত অ্যাকশন, রমরমে রোমান্স, জমজমাট ফিলগুড ছবি দেখতে দেখতে স্বাদবদল চাইছে। সপ্তর্ষি সেন, অপালা চৌধুরি লিখেছেন এই ছবির জন্যে এক শান্ত স্নিগ্ধ প্রেমের কাহিনি। কিন্তু বুননে গ্রিক ট্র্যাজেডির ভায়োলেন্স। এই আধুনিক দ্বৈরথ সপ্তাশ্ব বসু পরিচালিত এই ছবির প্রাণ।
এক কথায়, 'দেরি হয়ে গেছে' নারী-পুরুষের সম্পর্কের ছবি। গভীর প্রেমের ছবি। নিবিড় অপরাধবোধের ছবি। এবং মনকেমন এবং মধুর নস্টালজিয়ার ছবি। এতগুলি পরতে কোনও রকম নাটকীয়তা ছাড়া, অসামান্য সাবলীল মৃদু অভিনয়ে অঞ্জন দত্ত-মমতা শঙ্কর সারাক্ষণ নদীর মতো বয়ে গেলেন। ওঁরা অভিনয় করেননি। ওঁরা প্রকাশ করেছেন মৃদুতার মাধুর্য। সেই মৃদুতায়, স্নিগ্ধতায় মিশেছে শান্তিনিকেতন, সোনাঝুরি, মমতার হোমস্টের প্রশান্তি, আর অঞ্জন-মমতার যুগ্ম কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের অথৈ, ‘গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকে ছিল তারা/ আমার যা কথা ছিল হয়ে গেল সারা।’ কিন্তু কথা কি সারা হয় অত সহজে?
অঞ্জন দত্ত ছবিতে। সঙ্গে দারুন পার্শ্বচরিত্রে অরিজিৎ (দাদুল) দত্ত। সুতরাং সেই ছবিতে মদ্যমায়া থাকবে না, তা কি হয়? অথচ মমতার হোমস্টেতে মদ বারণ! এদিকে অঞ্জন এসেছেন মমতার হোমস্টেতে এক সপ্তাহ কাটাতে। এবং সাত বোতল রামের গায়ে সাতটি বারের নাম আলাদা আলাদা লেখা। অঞ্জনকে যে অনেক কথা বলতে হবে মমতাকে। আর মমতারও যে অনেক কথা বলার আছে অঞ্জনকে। অনেক বছর আগে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ ছিল এই দুই চরিত্র। তখন তারা তরুণ-তরুণী। একদিন অঞ্জন পরম লগ্নে পৌঁছতে পারলেন না। আর বিয়ে হয়ে গেল মমতার। তারপর বিচ্ছিন্ন এই নারী-পুরুষ। সুতোটা কি আবার তুলে নেওয়া যায় সেখান থেকে? নিশ্চয় যায়। বন্ধু অরিজিৎ বোঝান অঞ্জনকে। বলেন, মমতা এখন বোলপুরের পরের স্টেশন প্রান্তিকে হোমস্টে বানিয়েছেন। সেখানে কদিন কাটিয়ে এসো। সে এখন একা। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসো। তাই অঞ্জন মমতার হোমস্টেতে। তাঁরা ঘন হচ্ছেন ক্রমশ। একটি দৃশ্যে মমতা অঞ্জনকে বলেন তাঁর চোখে ড্রপ দিতে। বোঝা যায়, পুরনো টানে মরচে পড়েনি। কিন্তু এক গভীর অন্যায়বোধে কষ্ট পান অঞ্জন। তার পর মমতার ছবির অ্যালবাম দেখতে দেখতে....না থাক। বলব না। মনে পড়ে যায় প্রাচীন গ্রিক নাটক, কিম্বা, মিলান কুন্দেরার উপন্যাসের অতীত। অতীত থাকুক না ঢাকা। সে ঢাকনা খুলতে নেই।
