বিদিশা চট্টোপাধ্যায়: 'ফ্যামিলি ম্যান থ্রি' এল বেশ অনেকটা অপেক্ষার পর। বাকি অন্যান্য স্পাই থ্রিলারের চেয়ে এই সিরিজে সাধারণ মধ্যবিত্ত নায়কের উদযাপন থাকায় দর্শকের মনের অনেকটাই কাছের হয়ে উঠেছিল 'ফ্যামিলি ম্যান'। সেটাই এই সিরিজের ইউএসপি যাকে বলে। কিন্তু এবারে গল্পের কর্মকাণ্ডের যেভাবে বিস্তার ঘটেছে, সেখানে এই বিশেষত্ব যা 'ফ্যামিলি ম্যান'কে আলাদা করেছিল, সেটাই যেন 'ফ্যামিলি ম্যানে'র ফর্মুলা হয়ে উঠল। অর্থাৎ ফ্যামিলি ম্যানের যে চেনা ছক যেমন শ্রীকান্ত-জেকের মসকরা, স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে সংঘাত বা রসায়ন, তা গল্পে যেভাবেই হোক রেখে দেওয়া এই সিজনে তার প্রয়োজন থাক বা না থাক। ফলে কিছু হিট আর কিছু মিস হয়েই যায়। যেমন গোটা পরিবার যখন প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছে, সেখানে ট্রেনের ভেতর যেভাবে খোশমেজাজে গল্প চলছে, মনে হয় যেন সবাই এমনি বেড়াতে যাচ্ছে। কিংবা নাগাল্যান্ডে বিপ্লবীকে ধাওয়া করতে ইন্টারনেট ক্যাফের বাইরে জেকে যেভাবে খেতে ব্যস্ত যেন 'মিশন' নয় পিকনিকে এসেছে তারা। এমনকী মায়ানমারের জঙ্গলে শত্রুর হাতে পরাস্ত শ্রীকান্ত-জেকে যখন বন্দি, পালাতে না পারলে প্রাণ তো যাবেই, দেশেরও ক্ষতি হয়ে যাবে— এমন সিরিয়াস মুহূর্তে জেকে তার নিজের সদ্য ডেটিং জীবন নিয়ে কাঁদুনি গাইতে বসে। এতে না আছে হিউমার, না আছে চিত্র্যনাট্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। গোটা সিরিজজুড়ে একদিকে পরিবারের সমস্যা, হালকা হিউমার যা এই সিরিজের ট্রেড মার্ক এবং গম্ভীর জিওপলিটিক্যাল সমস্যা, কভার্ট অপারেশন, অস্ত্র-বাণিজ্য চুক্তি, নাশকতা— সমান্তরালভাবে মেশানোর একটা প্রক্রিয়া চলে গল্পে। যেটা কিছু জায়গায় ক্লিক করে গেলেও বেশিরভাগ সময়েই আলগা হয়ে থেকে যায়।
এই সিরিজ এবার ঝুঁকেছে নর্থইস্ট-এর দিকে। 'পাতাললোক'-এর পর উত্তর-পূর্ব ভারত সম্ভবত লেখকদের প্রিয় বিষয় হয়ে উঠেছে। যেখানে কেন্দ্রীয় সরকার এই অঞ্চলে ডেভেলপমেন্ট চায় এবং নতুন প্রজন্মের এই শান্তি-সংহতির প্রতি অবিশ্বাস একটা সংঘাত তৈরি করে। বিশেষ করে কাশ্মীর প্রসঙ্গ ছোঁয়া যখন বিপজ্জনক, তখন 'ফ্যামিলি ম্যান থ্রি' নির্মাতারাও নর্থইস্ট ফর্মুলার আশ্রয় নিলেন। এই গল্পের ভূ-রাজনীতির প্লটের সঙ্গে 'পাতাললোকে'র মিল খুব বেশি। তবে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চিন অ্যাঙ্গেল এবং বিদেশি কর্পোরেট অস্ত্র চুক্তি। এককথায় বলতে হলে, এক থালায় রকমারি পদ! কোনটা ছেড়ে কোন দিকে মন দেব? দর্শক হিসেবে বলা মুশকিল। তবে এবারের গল্পে 'অ্যান্টাগনিস্ট' নিয়ে বেশ চমক আছে। একদিকে লন্ডনের মীরা এস্টন (নিমরত কৌর) যে কিনা অভিজাত মহিলা ব্রোকার, এক ফোনেই 'ডিল ব্রেক' কিংবা 'মেক' করার ক্ষমতা রাখেন। বিদেশের বড়-বড় কর্পোরেট হাউস থেকে পাকিস্তানের আইএসআই-এর মেজর তার পকেটে। তাকে আমরা দেখি ফোনেই কাজ সারতে। শ্রীকান্ত তিওয়ারির জীবন তছনছ করে দিতে সে একাই একশো। অন্যদিকে খুবই মুডি ড্রাগমাফিয়া রুকমা (জয়দীপ আলাওয়াত)। মীরা এই রুকমাকেই ব্যবহার করে নাগাল্যান্ড, মিজোরামে কেন্দ্রীয় সরকারের শান্তি বৈঠক প্রোজেক্ট বাতিল করতে। রুকমার নিজস্ব একটা ছন্দ আছে। সে টাকা চেনে কিন্তু নিজের মতো করে রুলবুক তৈরি করে। পুলিশ এবং ড্রাগমাফিয়ার যুদ্ধে তার বান্ধবী মারা গেলে, তার কাছে খবর আসে শ্রীকান্ত তিওয়ারি এই হত্যার জন্য দায়ী। সে এক বাক্যে এই কথা কেন মেনে নেয় বোঝা যায় না, যেমন বোঝায় যায় না কুলকার্নিকে মারার পর সে কেন শ্রীকান্তকে ছেড়ে দিল? যাই হোক, শ্রীকান্ত তিওয়ারিকেই সে জাতশত্রু হিসেবে ধরে নেয়। এবার শ্রীকান্ত এবং রুকমার কাছে লড়াইটা ব্যক্তিগত। গল্পের এত ঘন ঘন গতি পরিবর্তন যেন হঠাৎ ব্রেক কষার মতো, ফলে ঝাকুনি হবেই। তবে ভালো লাগে অ্যাকশন দৃশ্যগুলো, উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রেক্ষাপটে একেবারে তাজা অ্যাকশন।
সিরিজের শেষের দিকে যেখানে শ্রীকান্তের অপারেশনের কথা পরিবারের সবাই জেনে গিয়েছে, সেখানে তার স্ত্রী সূচি বলে, আগে কত মিথ্যে বলার চেষ্টা করত শ্রীকান্ত, আমি মেনেও নিতাম অনেক কিছু, কিন্তু আজ আমি জানি প্রাণসংশয় নিয়ে ও কোথায় গিয়েছে। ফিরবে কিনা জানি না। ওর মিথ্যেগুলোই মিস করছি- এই দৃশ্যটা মন ছুঁয়ে যায়। তেমনই আরও একটা দৃশ্য আছে যেখানে রুকমা তার মৃত বান্ধবীর সন্তানকে নিয়ে কি করবে ভেবে পায় না। বিরক্ত হয়ে দাদুর বাড়িতে তাকে রেখে আসতে যায়। ঠিক সেসময়ে রুকমা গাড়িতে ওঠার আগে দুটো কচি হাত তাঁকে জড়িয়ে ধরে। সিরিজের নির্মাতারা রুকমাকে 'ফ্যামিলি ম্যান' তৈরি করবে নাকি হৃদয়হীন ড্রাগমাফিয়া বানাবে, শেষ পর্যন্ত ঠিক করে উঠতে পারেননি। কিন্তু এখানেও টেক্কা দিয়েছে 'পাতাললোক'। হাতিরাম চৌধুরী যে বাপ-মা মরা ছেলেটাকে বাড়ি নিয়ে আসে, তার উপস্থিতি সেই সিরিজে অনেক বেশি কার্যকরী। এখানে ববি ম্যাকফেরিন নামের শিশুটির উপস্থিতি কীভাবে কাজে লাগাবে নির্মাতারা বুঝতে পারেননি! কখনও সে মায়া এবং স্নেহ উদ্রেককারী, কখনও তাকে আবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। চমক আরও আছে। এই সিরিজের সঙ্গে 'ফরজি'র একটি যোগসূত্র স্থাপন করা হয়েছে। সেটা কী? তা এই পরিসরে না ভাঙাই ভালো।
আসলে অনেকগুলি প্লট সমান্তরালে টেনে গল্প সাজানোর চেষ্টা করা হয়েছে, যে কোনও ফ্রাঞ্চাইজির এটাই সমস্যা! প্রথমটা অনেক বেশি প্রমিসিং। কৌতূহল বাড়ায়। কারণ তার আগে বা পরে কাউকে কিছু প্রমাণ করার নেই। কিন্তু একবার সাফল্য ছুঁয়ে ফেললে সেটাকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় গল্প মূল জায়গা থেকে ক্রমে সরে নানান ক্লিশের পিছু ধাওয়া করে। সেরকমই এই সিরিজের শেষটাও যেন অসম্পূর্ণ।
