বিদিশা চট্টোপাধ্যায়: বাঙালি খাদ্যরসিক কিন্তু খাওয়া দাওয়ার সঙ্গে তার সম্পর্কটা খুব একটা স্বাস্থ্যকর নয় , বরং ইমোশনাল। মান অভিমান স্ল্যাশ অ্যাসিডিটি- বুক জ্বালা। বিচ্ছেদ-বেদনা স্ল্যাশ বা দিকে চিনচিন। অ্যানজাইটি স্ল্যাশ পেট গুড়গুড়। একগুয়ে স্ল্যাশ কোষ্ঠকাঠিন্য। আসলে ব্যাপার খুব জটিল সহজ নয়। কোনটা মোশন আর কোনটা বোঝা মুশকিল। আর সম্পর্ক? এই ব্যাপারে আমরা ধ্যারাতে ওস্তাদ। প্রেম হোক বা পেরেন্টিং কেস জন্ডিস। প্রতিম দাশগুপ্ত পরিচালিত ‘রান্না বাটি’ দেখতে দেখতে এই পুরনো রিয়ালাইজেশন নতুন করে হল তবে সেটার স্বাদ তেতো নয় বরং টক-মিষ্টি, ঝাল কম ।
তপন সিনহা পরিচালিত ১৯৬৬ এ 'গল্প হলেও সত্যি' আমাদের বুঝিয়েছিল খাওয়া-দাওয়াটা মন ভালো রাখার মোক্ষম দাওয়াই। তখন ‘ফুড ফিল্ম’ টারমিনোলজি কোথায়! আজকের এই আধুনিক পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন, অনেক নতুন আমদানি হলেও, কিছু রেসিপি তো একই থেকে যায়, তাই তো থাকার কথা। প্রতিম এই আধুনিক জীবনের মধ্যেই খুঁজে নিয়েছেন রান্না বাটি-র উপকরণ। মূল উপকরণ হলেন এক বাবা শান্তনু দাশগুপ্ত (অভিনয়ে ঋত্বিক চক্রবর্তী) আর তার মেয়ে মোহর (অভিনয়ে ইদা দাশগুপ্ত)। তাদের একেবারেই বনে না। ভেজ বিরিয়ানির চেয়েও খারাপ অবস্থা যাকে বলে আর কি। মোহরের ছিল মায়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব (অভিনয়ে সোলাঙ্কি রায়)। বাবার সঙ্গে সেটাই মিসিং। কোনও বোঝাপড়াই নেই। দীর্ঘকাল বাবার অনুপস্থিতি, কাজের ব্যস্ততায় বাবাকে চেনার সুযোগ পায়নি মোহর।
মা চলে যাওয়ার পর সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। স্কুলে, সহপাঠীদের ওপর সে রাগ উগরে দিচ্ছে। কী করবে শান্তনু? স্ত্রীয়ের মৃত্যুই সে প্রসেস করতে পারেনি। সে কী করে বুঝবে এই তেরো বছর বয়সী মেয়েটাকে! এই যে আমরা সব কিছু হজম করে, কিছুতেই ক্রাইসিসের মুখোমুখি হতে চাই না এ আমাদের বড় বদঅভ্যাস। প্রতিম আলতো করে হলেও সেই দিকটা ছুঁয়ে গিয়েছেন। নাকি ছবি দেখতে দেখতে দর্শকাসনে বসে সেটা আরও একবার বুঝে নিলাম, কারণ পরিচালক সেই দিকে ঠেলে দিলেন। গভীর শোক এমন এক অনুভূতি যা পুরোটা ধীরে ধীরে অনুভব করতে দিতে হয়। যত কষ্টই হোক না কেন আয়নার মতো তুলে ধরে আলিঙ্গন করতে হয়। পালাতে নেই। সম্পর্কের গিঁটও অনেক ধৈর্য ধরে, ভালোবাসা-যত্নে আসতে আসতে খোলার চেষ্টা করতে হয়। এর কোনও শর্টকাট নেই। তেমনি সুস্বাদু খাবার খেতে হলেও বাজারে গিয়ে তাজা উপকরণ কিনে আনতে হয়, রেডি টু ফ্রাইয়ের শর্টকাট ধরা মানেই প্রসেস না করা। প্রতিম যেন সেই কথাই বলতে চেয়েছেন। আসলে সম্পর্কের ছবি, বন্ধুত্বের ছবি, কিন্তু খেলছি রান্নাবাটি ।
ঋত্বিক চক্রবর্তী আর ইদা দাশগুপ্তের সব কটা দৃশ্যই খুব মনের কাছাকাছি থেকে যাবে। প্রথমে ইজি, হয়ে যাবে এমন একটা ভাব থেকে শান্তনুর অসহায়তা, বিপন্নতা ফুটে ওঠে। মোহরের সঙ্গে কথা কাটাকাটির পর হার মেনে যাওয়া দু চোখে থাকে সেই বিপন্নতা। ঋত্বিক চক্রবর্তী এই ছবির আগুন। এই গ্যাস না জ্বলে উঠলে রান্নাটাই হত না। যে দৃশ্যে মোহর বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে, আমার মনে পড়ে যায় ‘ইনসাইড আউট’-এর রাইলিকে। অ্যাঙ্গার, ডিসগাস্ট, ফিয়ার, জয় নিয়ে পথ হারিয়ে ফেলা রাইলিও বাবা মায়ের কাছে ফিরে আসে যখন সে, সরো-কে খুঁজে পায়। ঠিক যেমন বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পরে মোহর কেঁদেকেটে একসা করে তবেই শান্তি পায়। কান্নার জোর বড় জোর । দুঃখ পেরোতেই হয় সুখ পেতে । তাই কান্না পেরোনোও জরুরি খুব । যতই ঝাল লাগুক, পছন্দের আলু কাবলি, ফুচকা আমরা খেয়েই থাকি চোখের জল ফেলতে ফেলতে ।
তবে মূল উপকরণ ছাড়াও রান্নায় প্রয়োজন ফোড়ন, নুন, মিষ্টি, নাহলে স্বাদ হবে কেন। কমেডির মোড়কে একটা সিরিয়াস বিষয়কে এমন ভাবে ধরেছেন যে এটা প্রায় মাল্টিকুইজিন যাকে বলে। একই টেবিলে কন্টিনেন্টাল, ইন্ডিয়ান, মোঘলাই, মেডিটেরেনিয়ান! বিনা সংলাপেই সোলাঙ্কি রায় আবেগের উপকরণ মাপ মতো নিয়ে আসেন। অনির্বাণ চক্রবর্তীর ‘গোডো’ফোড়নের মশলার মতো । আছেন চার সিন, যতবার আসেন ডালে ফোড়ন পড়ার ঝাঁজ টের পাওয়া যায়। ইদা দাশগুপ্ত মন জয় করে নেন। সোহিনী সরকারের 'রিটা রে' আমেজে কন্টিনেন্টাল। কিন্তু তিনি এই ছবির সব রান্না জানা পাকা রাধুনি যে নিজের হাত পুড়িয়ে রান্নার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছেন এবং শান্তনুকেও শিখিয়েছেন। তবে তার মুখের সংলাপ লাগসই মনে হয়নি। আরেকটু বাস্তবঘেষা হলে কেমিস্ট্রি আরও জমত। রণজয়ের সুরে ‘দরজা খুলে দাও’গানটা মনে থাকবে। ঝকঝকে (ক্যামেরা তূর্য ঘোষ), স্মার্ট ফ্যামিলি ফিল্ম রান্নাবাটি। সম্পর্কের রেসিপি নিয়ে রান্নাটা প্রতিম দাশুগুপ্ত মন্দ করেন না, বলাই যায় ।
