shono
Advertisement

বিরলতম নায়িকা সংবাদ, কেমন হল 'বিনোদিনী: একটি নটীর উপাখ্যান'? পড়ুন রিভিউ

রুক্মিণী মৈত্রর পাশাপাশি 'বিনোদিনী'র 'ম্যান অফ দ্য ম্যাচ' কে?
Published By: Sandipta BhanjaPosted: 06:20 PM Jan 23, 2025Updated: 06:26 PM Jan 23, 2025

'বিনোদিনী: একটি নটীর উপাখ্যান' দেখে লিখছেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ‌্যায়। 

Advertisement

মুম্বইয়ে হিন্দি ছবির পরিচালক রামকমল মুখোপাধ্যায়। সদ‌্য মুক্তি পাওয়া তাঁর প্রথম বাংলা ছবির বিস্তৃত নাম, ‘বিনোদিনী : একটি নটীর উপাখ্যান’ (নটি বানানে আজকাল দীর্ঘ-ই বর্জন করারই প্রবণতা)। তবে নামটা আমার কল্পনায় তেড়ে হতে চাইছে, ‘একটি নদীর উপাখ্যান’। কেননা ছবিটা দেখতে দেখতে অবশ্যই মনে হয়েছে, রামকমল সারা বিনোদিনী বিন্যাসে, তাঁর শরীরে, নাচগানে, উদ্যমে ক্লান্তিতে, রূপের ঝলকে, বেদনার বুননে, উল্লাসে ক্রন্দনে, প্রবল প্রকাশে, সূক্ষ্ম দ্বিধায়, প্রণয়ের উজানে ও দ্যোতনায়, নিয়ে এসেছেন রুক্মিণী নামের একটি নদীর বর্ণময় বহতা। কেননা, আমার মনে হয়েছে, রামকমলের বিনোদিনী তাঁর বিস্তীর্ণ রুক্মিণী আচ্ছন্নতার সোনালি ফসল, সৃজনী উদ্‌যাপন। রুক্মিণী এই ছবির মজবুত মেরুদণ্ড। তপ্ত তারল্য।

বিনোদিনীর জন্ম ১৮৬৩-তে। কলকাতার কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের পতিতা বস্তিতে। জীবনের শুরুতে সেই নরকে সে পুঁটি নামের দুবেলা খেতে না-পাওয়া এক মেয়ে। তাকে জোর করে ঠেলে দেয় তার মা-দিদিমা সমাজ আদি ব্যবসার পথে। কিন্তু সেই পুঁটি একদিন পৌঁছল বাংলা থিয়েটারের সুপারস্টার গৌরবে। এবং বিনোদিনী আগুন পোড়াল কলকাতার অনেক বাঙালি, অবাঙালি পতঙ্গবাবুকে। বিনোদিনী বহ্নিস্রোত পৌঁছল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে। কিন্তু মাত্র ২৩ বছর বয়সে গিরিশবাবু এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিলেন বিনোদরূপকথা : বিনি দেখতে দেখতে তুই তেইশ বছরের বুড়ি হয়ে গেলি। কলকাতার বাবুরা আর তোকে চাইছে না। সে যুগে এখানেই শেষ এক তরুণীর প্রতিভা-উজ্জ্বল সম্ভাবনা ও আরোহণ। কিন্তু এ যুগে সম্ভব হল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অঙ্গুলি হেলনে গিরিশ ঘোষের সমস্ত অন্যায়ের অবসান। সম্ভব হল সেই স্টার থিয়েটারের ছলনার বিনির্মাণ এবং সেখানেই বিনোদিনী থিয়েটারের নির্মাণ। মাঝখানে ১৪০ বছরের দোলাচল ও অপেক্ষা। তারপর বিনোদিনী থিয়েটারেই বিনোদিনী সিনেমার মুক্তি। মঞ্চের বিনোদিনী এবার সিনেমারও মহাতারকা বিনোদিনী। নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। স্বয়ং গিরিশ ঘোষ মঞ্চ থেকে বললেন কৌশিক গঙ্গোপাধ‌্যায়ের কণ্ঠে, "আমার আত্মা এতবছর পরে শান্তি পেল।" আর স্বয়ং বিনোদিনী রুক্মিণীর হাতে তুলে দিলেন তাঁর দীর্ঘ সমর এবং প্রতীক্ষার শেষে এক অলীক বিজয়বৈজয়ন্তী। কাকতালীয় নয়। মিরাকল আজও ঘটে। আজও মর্তভূমিতে ঝরে পড়ে শ্রীরামকৃষ্ণের মাঙ্গলিক আনয়ন ও আশীর্বাদ। রামকমল, অভিনন্দন আপনাকে। আপনার ছবি বিনোদিনী বহিয়ে দিল সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি নায়িকাকে একাল-সেকালের সঙ্গম স্রোতে। রুক্মিণী, প্রাণের আশীর্বাদ তোমাকে, তোমার রুক্মিণী বহতায় বিনোদিনী পেলেন এক কালজয়ী সাঁতার। আমি নিশ্চিত, এ যুগের বাঙালি প্রতিদিন দলে দলে সাক্ষী দান করবে তোমার প্রবাহের, প্রতাপের, প্রাবল্যের, প্রতিভার। তোমাকে পৌঁছে দেবে কালসন্ধির উৎসবায়নে! সেই দৃশ্য মনে থাকবে বাকি জীবন, যে দৃশ্যে ব্রিটিশ মহিলা সাংবাদিক এবং ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার তোমাকে আবিষ্কার করছে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে। এবং গিরিশবাবুকে পাশে নিয়ে, তাঁর সাহায্যের কোনওরকম তোয়াক্কা না করে, তুমি নির্ভুল ইংরেজিতে পৌঁছে যাচ্ছ নিটোল আন্তর্জাতিকতায়। দাশু (গৌতম হালদার) ক্লীবতম ভঙ্গিতে প্রশ্ন করছে, গিরিশবাবুর যুগ কি শেষ হল? আর এই মুহূর্তে শুরু গিরিশের ঈর্ষা, ক্রোধ, প্রতিশোধ স্পৃহা, প্রতারণা। এবং রুক্মিণী - বিনোদিনী তোমার একের পর এক বিপর্যয়, বেদনা, শূন্য হয়ে যাওয়া। এবং কত বছর পরে তোমারই মাধ্যমে ফিরে এলেন বিনোদিনী গ্রহণ শেষে নতুন সূর্যের দুর্বার দ্যুতিতে। কেন সেটা এমন অবিশ্বাস্য ভাবে সম্ভব হল জানো? তোমার বিনোদিনী হওয়ার সমস্ত সার্থকতা উঠে এসেছে তোমার বিনোদিনী-মগ্নতা, বিনোদিনী-ধ্যান, বিনোদিনী- একাত্মতা থেকে। এক সংবেদনহীন পুরুষশাসিত ও শোষিত বাঙালি সমাজে এক অনন্যার সততা, সাহস ও অধিকারের যুদ্ধকে তুমি আত্মস্থ করতে পেরেছ। এইখানেই তোমার জয়ের অর্জিত ভূমি, চর্চিত সম্পদ। এখানে একটা খুব জরুরি বার্তা। এই ছবিতে দৃশ্যের পর দৃশ্যে এবং ছবির পোস্টারে তোমার আয়ত আঁখিপাতের কবোষ্ণ ক্লোজআপ ফুটিয়ে তুলেছে তোমার বিনোদিনী- হিরণ্ময়তাকে। এই যে সারা ছবি জুড়ে তোমার চাউনি বিন্যাসের বিচিত্রা বুনে দিলেন রামকমল, এ তোমার সৌভাগ্যের দান নয়। এ তোমার ব্যাকুল নয়নে ভাবের খেলার স্বাক্ষর।

রুক্মিণী, তুমি গিফটেড। অস্তিত্ব জুড়ে চৈতন্যের উদয় ছাড়া এমন চোখের চাওয়ার হওয়া বইতে পারে না। যে দৃশ্যে শ্রীরামকৃষ্ণদেব (চন্দন রায় সান্যাল) তোমার মহাপ্রভুরূপে আচ্ছন্ন হয়ে বলছেন, মা তোর চৈতন্য হোক, তুমিও সত্যিই বিনোদিনীর মতো শ্রীরামকৃষ্ণের এই চৈতন্য দানকে শেষ প্রত্যয়ভূমি করে নিতে পেরেছ, সর্বগ্রাসী বিপর্যয়ের মধ্যে। কী অসামান্য নাচ, গান, মায়াময় মাতোয়ারার মধ্যে ঘটছে তোমার চৈতন্য উদয়। একদিন যা সত্যি ঘটেছিল, তাই আরো একবার ঘটালে তুমি। একেই তো গ্রিকরা বলেছিল, মায়মেসিস! মায়াময় ছায়াবাস্তব। আরও একটি বার্তা: রাঙাবাবু (রাহুল বোস) থেকে কুমারবাহাদুর (ওম সাহানি) থেকে গুরমুখ রায় (মীর), এরা আজও বর্ণিল বর্তমান। এরা আজও সবাই চায় বিনোদিনীর মতো রূপবতী, গুণবতী, অসহায় সহজিয়াকে কিছুদিনের বন্ধনহীন গ্রন্থিতে। পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থী, এমন পুরুষভোগ্য ডায়াবলিক ডাইকোটমি ভুবনে আর আছে নাকি? পুরুষের এই দায়িত্বহীন বিভাজিত সম্পর্কবাদের বারবার শিকার বিনোদিনী! একথা একবারও ভাবছি না, বিনোদিনী শিশুর সারল্যে পুরুষের বিতংসে পা রেখেছেন একটিবারও। কিন্তু তিনি তাঁর প্রবণতা ও প্রতিভার তাড়নায় আজীবন চেয়েছেন একটি স্বাধীনভাবে অভিনয় মঞ্চ। এবং সেটি পাওয়ার জন্য পুরুষ যা চায়, সেটি দিতে দ্বিধা করেননি। কিন্তু গিরিশ? গিরিশ তো বিনোদিনীর গুরু, জীবনদেবতা, ভাবনাসঙ্গী, বান্ধব, আশ্রয়।

ছবি: ইনস্টাগ্রাম

গিরিশের মধ্যে ম্যাকিয়েভেলিয়ান ভিলেনির বিন্দুমাত্র আভাস পাননি বিনোদিনী। এমন ছিল গিরিশচন্দ্র ঘোষের নিপুণ অন্তরাল! গিরিশই কিন্তু এই ছবির নায়ক। গিরিশ নায়ক। রুক্মিণী নায়িকা। মনে রেখো রুক্মিণী, যতবার জীবনে তোমার বিপরীতে কৌশিক গঙ্গোপাধ‌্যায়কে পাবে, ততবার সন্তর্পণে পা ফেলতে হবে। কেননা কৌশিক বিপজ্জনক প্রতিভাবান। হাসতে হাসতে মৃদু কণ্ঠের ম্যাকিয়েভেলিয়ান শীতলতায় একমাত্র সেই পারে পায়ের তলা থেকে কার্পেট সরিয়ে দিতে। এই ছবিতেও করেছে কি? সব কথা বলতে নেই। শুধু মনে রেখো, কৌশিক মাস্টারক্লাস! এবং ওর বিপরীতেই তুমি আরও জ্যোতির্ময় হওয়ার প্রেরণা পাবে! অ্যাডভান্টেজ রুক্মিণী। ডিউস?

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • রুক্মিণী, তুমি গিফটেড। অস্তিত্ব জুড়ে চৈতন্যের উদয় ছাড়া এমন চোখের চাওয়ার হওয়া বইতে পারে না।
  • একদিন যা সত্যি ঘটেছিল, তাই আরো একবার ঘটালে তুমি। একেই তো গ্রিকরা বলেছিল, মায়মেসিস! মায়াময় ছায়াবাস্তব।
Advertisement