কৃশানু মজুমদার: বড্ড মনে পড়ে ২০১৪ সালের ১৩ জুলাইয়ের সেই প্রহর। ফিফা প্রেসিডেন্ট শেপ ব্লাটারের হাত থেকে গোল্ডেন বল হাতে নিয়ে তিনি নেমে এসেছিলেন পোডিয়াম থেকে। হাজার বছরের ক্লান্তি যেন ভর করেছিল পায়ে। ধীরগতি। নিঃসঙ্গ। বিধ্বস্ত চেহারা। দৃষ্টিতে শূন্যতা। বুকে কেউ যেন পাথর বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিল সেদিন।
কিংবা তার-ও বছর দুয়েক পরের এক জুন মাস। কোপা ফাইনালের আলো মাখা সেই স্টেডিয়ামে আচমকাই যেন নেমে এসেছিল অমানিশার অন্ধকার। মাঠে বসেছিলেন তিনি। সব হারানোর চোখের জল ঝরে পড়েছিল মেটলাইফ স্টেডিয়ামের সবুজ ঘাসের মখমলে।
পেনাল্টি মিস করে তিনি খলনায়ক। সেই মঞ্চেই ফুটবলকে বিদায়ের ঘোষণা। একের পর এক ট্র্যাজেডির আবর্তে ঢেকে গিয়েছিল ফুটবল বিশ্ব।
কাট টু ১৪ জুলাই, ২০২৪। ফের সেই কোপার ফাইনাল। এবারও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেডিয়াম। নিউ জার্সির বদলে মিয়ামির হার্ড রক। রক কনসার্টের প্রান্তরে ফুটবল কনসার্ট। সেখানেও খেলার মাঝে নেমে এল বিপর্যয়। দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি সময়ে দৌড়তে গিয়ে পেশিতে টান পড়ল। যন্ত্রণাকাতর তিনি। খোঁড়াতে খোঁড়াতে মাঠ ছাড়লেন। তার পরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। পুরো সময় মাঠে থাকতে পারলেন না ফাইনালে। কিন্তু দিনান্তে তিনি হাসছেন। হাসছে তাঁর আর্জেন্টিনা। মার্টিনেজের গোলে মেসির মুখে হাজার হাজার ওয়াটের আলো। রাজার শিরস্ত্রাণ উঠল মাথায়।
ট্রফি হাতে মেসি।
[আরও পড়ুন: কোপা আমেরিকার রং নীল-সাদা, কলম্বিয়াকে হারিয়ে ফের সেরার আসনে মেসির আর্জেন্টিনা]
লিওনেল মেসির (Lionel Messi) চিত্রনাট্য কে লেখেন? প্রত্যাবর্তনের সম্রাট তো তিনিই। মাইকেল জর্ডন এনবিএ ছেড়ে ফিরে এসে দুনিয়া জয় করেছিলেন। অবনমনের দুনিয়া থেকে ফিরে এসে লেস্টার সিটির প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়া কিংবা অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ফলো অনের লজ্জা এড়িয়ে ইডেনে লক্ষ্মণ-দ্রাবিড়ের অতিমানবীয় ইনিংসের সেই ক্যামব্যাক। প্রত্যাবর্তনের ক্যাবিনেটে এক-একটা উজ্জ্বল স্মারক। তবে ফিরে আসাদের লকার রুমের সবথেকে উজ্জ্বল ট্রফি বোধহয় হাজির হয়ে গেল সোমবারের সকালে।
যন্ত্রণাকাতর মেসি হাপুস নয়নে কাঁদছেন। মাঠে নামতে পারছেন না তিনি। এদিকে তাঁর সতীর্থরা অধিনায়কের জন্য জীবনপণ করে দিচ্ছেন মাঠে। এ কেমন হতাশা তা কেবল ভুক্তভোগীই বোঝেন!
বিশ্বকাপ-কোপা ফাইনালে হেরে যাওয়ার পর অভিশাপের কলঙ্ক নিয়ে বিদায় জানিয়েছিলেন দুনিয়াকে। সেই ঘোর অমাবস্যার আট বছরের মাথায় যেন সত্যিকারের পূর্ণিমা দেখল বিশ্ব। সেদিনও তিনি কাঁদছেন। এই কান্না যন্ত্রণার। না খেলতে পারার। সেই তিনিই আবার হাসছেন জয়ের আনন্দে। কোপা (Copa America Final 2024) জয় সম্পূর্ণ করে ট্রফি তুললেন হাতে। সতীর্থ দি মারিয়া, ওতামেন্দির হাতে তুলে দিলেন বহু কাঙ্খিত কাপ।
চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন মেসি। তার পরে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
জোড়া কোপাজয়। কোহিনূরের দ্যুতি ছড়িয়ে বিশ্বকাপ জয়-ও সম্পূর্ণ। ট্র্যাজেডির রাত সরিয়ে রোমান্সের মহাকাব্য লেখাও সম্পন্ন। এর থেকেও গ্রেটেস্ট কামব্যাক কি সম্ভব আদৌ? যদিও ইতিহাস বইয়ের পাতায় লেখা থাকবে, এবারের কোপায় মেসি নিজের নামের প্রতি একেবারেই সুবিচার করেননি। রেকর্ড বইতে আবার এও লেখা থাকবে, আর্জেন্টাইন অধিনায়কের নাম লিওনেল মেসিই।
খর্বকায় আর্জেন্টাইনের ফুটবল-জীবনের বুঝি দুটো অর্ধ। প্রথামার্ধে নীল-সাদা জার্সিতে কেবল ব্যর্থতাই তাঁর সঙ্গী হয়েছে। আর কেরিয়ারের সায়াহ্ন যেন তাঁর ফুটবলার জীবনের দ্বিতীয়ার্ধ। সেই মানুষটাই সাফল্যের এক শৃঙ্গ থেকে আরেক শৃঙ্গে আরোহন করছেন। মনে করিয়ে দিচ্ছেন সেই মিডাস রাজার কথা। যা ধরছেন, তাতেই সোনা ফলছে।
অথচ এক সময়ে ক্লাব-সর্বস্ব রেকর্ড আউড়ে দুনিয়া বারবার তাঁকে নিক্ষেপ করেছে অন্ধকারে। বলা হত, 'বন্যেরা বনে সুন্দর, মেসি বার্সেলোনায়।' দেশের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময়ে তাঁর ঠোঁট নড়ে না কেন, তা নিয়ে বিস্তর হইচই। মাথা পেতে নিয়েছেন অসম্মানের তিলক।
কেরিয়ারের এই পড়ন্ত বেলায় পূণ্যস্নান করে তিনি ফিরে এসেছেন দেবদূত হয়ে। এই ৩৭-এও নিজেকে প্রমাণ করার মরিয়া চেষ্টায় তিনি। সমালোচকদের জবাব দিয়েছেন দেশের নীল-সাদা জার্সিতে একের পর এক ট্রফি জিতে। বিশ্বজয়ের শিরোপা পরিয়ে দেশের ফুটবলে স্বর্ণ প্রজন্মের পালক যোগ করেছেন দি মারিয়া, ওতামেন্দিদের নিয়ে। উদ্বুদ্ধ করেছেন ক্রীড়াপ্রেমীদের।
দুটো ইউরো একটা বিশ্বকাপ জেতা স্পেনের সেই সোনালি সময় যেন টাইম মেশিনে চেপে হাজির হয়ে গিয়েছে লাতিন আমেরিকায়, আর্জেন্টিনার হাত ধরে। নিজের ফুটবল ধাত্রীগৃহ বার্সেলোনার বন্ধু জাভি, ইনিয়েস্তা, বুস্কেটস, পুওলদের সঙ্গে তিনিও বসে পড়লেন একই ব্র্যাকেটে। ফুটবল যে জীবন নয়, এরপরেও কেউ অমত হবেন?
প্রশ্ন জাগে, স্যর আলফ্রেড হিচকক-ও যদি ফুটবল নিয়ে নিজের ছবির স্ক্রিপ্ট লিখতেন, এত টুইস্ট হাজির করতে পারতেন?
শেষে একটা কথা বলাই যায়, মেসি তাঁদেরই দলে, যাঁরা বারবার অতল গহ্বর থেকে ফিরে এসে অবিশ্বাস্য কামব্যাকের রূপকথা লেখেন। অস্ফুটে বলে দিয়ে যান, ব্যর্থতা চিরকাল নিত্যসঙ্গী হয় না। কোথাও ন্যায়বিচার অপেক্ষা করে থাকে।