প্রসূন বিশ্বাস: জীবনপঞ্জি বলছে, চৌষট্টি পেরিয়ে পঁয়ষট্টির পথে পা বাড়াতে চলেছেন তিনি। কিন্তু বয়স তাঁর কাছে যেন একটা সংখ্যামাত্র! নয়তো এত প্রাণশক্তি পান কোথা থেকে? রবিবাসরীয় সকাল সকাল কলকাতা বিমানবন্দরে পা রেখেছিলেন প্রাক্তন বিশ্বকাপজয়ী জার্মান অধিনায়ক লোথার ম্যাথাউস। সেই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত একইভাবে ছুটে গেলেন প্রাক্তন বিশ্বজয়ী কিংবদন্তি। বিএসএলের ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়েছেন ম্যাথাউস। রবিবার যে যে জায়গাতেই গিয়েছেন, সব জায়গাতে গিয়েই একই কথা বলেছেন, এত বড় দেশ, এত কোটি কোটি মানুষ। এখান থেকে পঞ্চাশজন ফুটবলার জাতীয় দলের জন্য উঠে আসবে না! যারা বিশ্বকাপে তুলে নিয়ে যাবে ভারতকে।”
এদেশের কোনও বিখ্যাত প্রাক্তন ফুটবলারও কি এতটা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এই কথাটা বলতে পারবেন? আর বললেও, ফুটবলপ্রেমীরা সেই কথা শুনে হাসবেন হয়তো। হয়তো ভাবছেন আমাদের দেশের ফুটবল র্যাঙ্কিং সম্পর্কে উনি জানেন না। সেটাও ঠিক নয়, সন্ধ্যায় আইএফএ'র বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এসে নিজেই জানিয়ে গেলেন, “আমি জানি ভারতের ফিফা র্যাঙ্কিং ১৩৬। কিন্তু সময় লাগুক। সঠিক শিক্ষা আর শিক্ষক পেলে বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার স্বপ্ন দেখাই যায়।” গতমাসেই বেঙ্গল সুপার লিগের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হওয়ার পর তিনি জানিয়েছিলেন, এক মাসের মধ্যেই শহরে আসছেন। তাঁর দেওয়া কথামতো একমাসের মাথায় শহরে এলেন বান্ধবী তেরেসাকে নিয়ে। এদিন সকালে যখন কলকাতা বিমানবন্দরে এলেন, তখন বেঙ্গল সুপার লিগের উদ্যোক্তা শ্রাচী স্পোর্টসের কর্তাদের পাশাপাশি বিমানবন্দরের বাইরে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা লাল-হলুদ পতাকা নিয়ে স্বাগত জানিয়েছেন। বিমানবন্দরের বাইরে যখন তিনি আসেন, তখন তাঁকে দেখা যায় লাল-হলুদ জার্সি গায়ে।
রবিবার সকাল সকাল কলকাতায় পা রেখেই ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে তিনি চলে আসেন সাউথ সিটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। সেখানে একটি ফুটবল ক্লিনিকে অংশ নেন তিনি। দীর্ঘ বিমানযাত্রার ধকল কাটাতে তখন তাঁর বান্ধবী হোটেলেই বিশ্রাম নিলেন। কলকাতার দশটি নামী স্কুলের প্রায় দেড়শোর বেশি খুদে ফুটবলার এই ফুটবল ক্লিনিকে অংশ নিয়েছিল। ক্লিনিকে এসে দেড়শো খুদের সঙ্গে যেন মিশে গেলেন ম্যাথাউস। গায়ে 'এলএম' লেখা বেঙ্গল সুপার লিগের জার্সি, মুখে ওয়ারলেস মাউথপিস নিয়েই সারা মাঠে ছুটে তালিম দিয়ে গেলেন। এরমধ্যেই খুদে ফুটবলারদের আবদার ছিল সইয়ের। হাসিমুখে সেই আবদার মেটালেনও। তার আগে অবশ্য দীর্ঘক্ষণ মাস্টারক্লাস করালেন এই খুদেদের। এই ফুটবল ক্লিনিকে উপস্থিত ছিলেন ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য, মেহতাব হুসেন, রহিম নবি, ব্যারেটো, সুলে মুসা, আলভিটো ডি’কুনহা-সহ একঝাঁক প্রাক্তন ফুটবলার। ম্যাথাউসের এই প্রাণশক্তি দেখে মুগ্ধ এই প্রাক্তনরাও। সেখানকার পাঠ চুকিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরের একটি পাঁচতারা হোটেলে বাঙালি খাবার দিয়েই দুপুরের মধ্যাহ্নভোজ সারেন এই কিংবদন্তি। দ্রুত মধ্যাহ্নভোজের পর সেখানেই শহরের কিছু বাছাই করা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। তখন সেই নীল জার্সির উপর বেঙ্গল সুপার লিগের কোট চেপেছে তাঁর। বিশ্রাম নিয়ে সঙ্গী বান্ধবী তেরেসাও। সেখান থেকেই গেলেন কলকাতা পুলিশের একটি অনুষ্ঠানে। সেই অনুষ্ঠানে ছিলেন কলকাতা পুলিশ কমিশনার মনোজ ভার্মা।
কলকাতা পুলিশের অনুষ্ঠানে পুলিশ কমিশনার মনোজ ভার্মার সঙ্গে ম্যাথাউজ। ছবি: সুখময় সেন
কলকাতা পুলিশের অনুষ্ঠান শেষ করে সেখান থেকে টাউন হল ছুটলেন। তখন সূর্য পশ্চিমে ঢলেছে। টাউন হলে যোগ দিলেন আইএফএ'র পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে। সেখানে এসে হাসিমুখে সফল কোচ-ফুটবলারদের হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন তিনি। কোনও ক্লান্তি নেই চোখেমুখে। সদ্য জাতীয় সাব জুনিয়র ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন বাংলার ফুটবলার, বিসি রায় ট্রফি চ্যাম্পিয়ন দলের ফুটবলার ও সিনিয়র ন্যাশানাল মেয়েদের বাংলা দলকে উৎসাহ দিয়ে গেলেন। তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেক ফুটবলারের সঙ্গে নিজে থেকেই কথাও বললেন। ডায়মন্ড হারবার এফসি'র ফুটবলারদের হাতেও পুরস্কার তুলে দিলেন। ভবানীপুর এফসি'কে এই মঞ্চ থেকে অনূর্ধ্ব-১৩ রাজ্য যুব লিগ রানার্স ও অনূর্ধ্ব-১৫ রাজ্য যুব লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য পুরস্কৃত করা হয়।
এখানেই শেষ নয়, আইএফএ'র পুরস্কার মঞ্চে উপস্থিত একঝাঁক প্রাক্তন বিদেশ বসু, কম্পটন দত্ত, কার্তিক শেঠ, রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য, দীপেন্দু বিশ্বাস, সঞ্জয় মাঝিদের সঙ্গে কথাবার্তা দেখে মনেই হয়নি, তাঁদের সঙ্গে এই প্রথম দেখা হচ্ছে তাঁর। ইস্টবেঙ্গল ফুটবলার সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়, তন্ময় দাসদের থেকে জেনে নিলেন তাদের পজিশন। খেলার ধরন। এতবড় কিংবদন্তির এমন ব্যবহারে আপ্লুত লাল-হলুদ ফুটবলাররা। আইএফ'র এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, আইএফএ চেয়ারম্যান সুব্রত দত্ত, সচিব অনির্বাণ দত্ত-সহ অন্য শীর্ষ কর্তারা। কিন্তু এই অনুষ্ঠানে ক্রীড়ামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়নি ম্যাথাউসের। তবে এখান থেকে যখন তিনি সল্টলেকের হকি স্টেডিয়ামে বেটন কাপের ফাইনালে উপস্থিত হলেন ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা হল তাঁর। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রী সুজিত বসুও। বেটন কাপ থেকে ম্যাথাউস রাতে যোগ দিলেন আরও একটি অনুষ্ঠানে। সেখানে সঙ্গীত শিল্পী অনুপম রায় তাঁকে গান শোনান। এই অনুষ্ঠানে তাঁকে দেখা গেল বাঙালি পোশাক ধুতি-পাঞ্জাবিতে। আর তাঁর বান্ধবী পরলেন শাড়ি। সোমবার ভোর ভোর কলকাতার এই সুখকর স্মৃতি নিয়ে ফের উড়ে যাবেন জার্মানি।
