দুলাল দে: একদিনের ঝটিকা সফর। সকালে বিমানবন্দর থেকে সোজা সাউথ সিটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। সেখান থেকে তাজবেঙ্গলে লাঞ্চ। পড়িমরি করে ছুট কলকাতা পুলিশের ফুটবল ফাইনালে বডিগার্ডে। সেখান থেকে টাউন হলে আইএফএ'র পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। তারপর বেটন কাপের ফাইনাল ছুঁয়ে ফের তাজবেঙ্গলের অনুষ্ঠানে। সারাদিন-রাতজুড়ে এই ব্যস্ততার মধ্যে আলাদা করে কথা বলবেন সময় কোথায়? কিন্তু তিনি লোথার ম্যাথাউস। ’৯০-এর বিশ্বকাপ ফাইনালের ট্রফি যখন দু’হাত দিয়ে তুলে ধরেছিলেন, সেই দৃশ্যে মারাদোনার অশ্রুপাতের সঙ্গী বাংলা ছাড়িয়ে আপামর ভারতবাসী। লক্ষ লক্ষ মারাদোনাপ্রেমীর হৃদয় সেদিন ভেঙে দিয়েছিলেন এই জার্মান তারকা। সেই লোথার ম্যাথাউসকে হাতের কাছে পেয়ে ৩৫ বছর আগের সেই রাতের অনুভূতি না জানতে পারলে তাহলে আর রইলটা কী?
প্রশ্ন: বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে যখন ইন্টারভিউ দিতে বসেছেন, আপনার সঙ্গে মারাদোনার ডুয়েলের ব্যাপরাটাই নিশ্চয়ই সবার আগে এসেছে?
লোথার: (পাশে বসা বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন) শুধু তো বিশ্বকাপে নয়। ক্লাব ফুটবলে আমি তখন ইন্টার মিলানে আর মারাদোনা নাপোলিতে। লড়াইটা লেগেই ছিল। কিন্তু সেটা মাঠের মধ্যেই। মাঠের বাইরে কোনও লড়াই ছিল না।
প্রশ্ন: সেই সময়ের সেরা দুই ফুটবলার। তাহলে নিশ্চয়ই অসাধারণ বন্ধুত্ব ছিল?
লোথার: মেসি আর রোনাল্ডোর যেরকম বন্ধুত্ব। আমাদের মধ্যেও সেরকম বন্ধুত্ব বলতে পারেন। মাঠের বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মেসি আর রোনাল্ডোকে দেখবেন কথা বলছে। কিন্তু আড্ডা দেওয়ার জন্য দু’জনে একসঙ্গে ডিনার করতে গিয়েছে, এরকমটা কোথাও দেখবেন না। আমাদের সম্পর্কটাও সেরকম ছিল। এক অপরকে সম্মানের চোখে দেখতাম। বাট মারাদোনা জিনিয়াস ছিল।
প্রশ্ন: ’৯০-এর বিশ্বকাপের পর এক সাক্ষাৎকারে মারাদোনা বলেছিলেন, মাঠের মধ্যে তাঁকে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় ফেলেছিলেন লোথার ম্যাথাউজ...
লোথার: মারাদোনার মহানুভবতা। আমাকেও সবচেয়ে বেশি যদি কেউ প্রবলেম দিয়ে থাকে, সে মারাদোনা। তবে হিসেব কষে দেখুন, দু’জনের এই লড়াইয়ে মারাদোনার বিরুদ্ধে আমার সাফল্যর হার কিন্তু সবচেয়ে বেশি।
প্রশ্ন: ’৮৬-র বিশ্বকাপ ফাইনালে হারের পর, ’৯০-এর ফাইনালে ফের মারাদোনার আর্জেন্টিনা। ফাইনালের আগে মারাদোনাকে নিয়ে চাপে ছিলেন না?
লোথার: ফাইনালের আগে মারাদোনাকে নিয়ে আমাদের মধ্যে একটা আলোচনা হয়েছিল। আমরা নিশ্চিত ছিলাম, ’৮৬-র ফাইনালে মারাদোনা যে ফর্মে ছিল, ’৯০-এর ফাইনালে সেই ফর্ম ছিল না। আর আমরা দল হিসেবে আর্জেন্টিনার থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিলাম। ঠিক করেছিলাম, যাই হোক মনঃসংযোগ হারানো চলবে না। শেষ মুহূর্তে পেনাল্টিটা পেয়ে যাই।
প্রশ্ন: এর আগে কোয়ার্টার ফাইনাল এবং সেমিফাইনালে পেনাল্টি শট আপনি মারতে গিয়েছিলেন। তাহলে ফাইনালে সেই কঠিন মুহূর্তে আন্দ্রে ব্রেহমকে কেন পাঠালেন?
লোথার: (হেসে) এর পিছনে একটা মজার গল্প আছে। এমনিতে পেনাল্টি পেলে আমি শট নেব, এটাই ঠিক ছিল। কিন্তু হাফ টাইমের ঠিক আগে আমার বুটটা ছিঁড়ে গেল। টানা এক বুটে খেলতে খেলতে সেট হয়ে গিয়েছিল। হাফ টাইমে নতুন মডেলের একটা বুট পরলাম। শেষের দিকে যখন পেনাল্টি পেলাম, তখন মনে হল, বুটটা ঠিক সেট হয়নি। এই অবস্থায় শট নেওয়া ঠিক হবে না। আন্দ্রের সঙ্গে এমনিতেই আমার বোঝাপড়া দারুণ। জানি গোল করলে আমি হিরো। তবু নিজের ইগো সরিয়ে রেখে আন্দ্রেকে বললাম, পেনাল্টিটা নিতে। বাকিটা ইতিহাস।
প্রশ্ন: দেখুন, স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্নটা চলে আসে, মেসি না মারাদোনা? কাকে এগিয়ে রাখবেন?
লোথার: দেখুন, এভাবে তুলনা হয় না। ৩৫ বছর আগে আমি-মারাদোনা যে ফুটবলটা খেলতাম, তার থেকে ফুটবল এখন অনেক গতিময় হয়ে গিয়েছে। এখনকার সময় থেকে আমাদের সময় ফুটবল অনেক স্লো ছিল। আবার যদি পেলের সময়ের ফুটবল দেখেন, এখন মনে হবে, স্লো মোশনে দেখছেন। ফলে ভিন্ন ভিন্ন সময়ের সঙ্গে কীভাবে তুলনা করবেন? তবু মারাদোনার ভক্ত আমি।
প্রশ্ন: আচ্ছা, মেসি আর রোনাল্ডোর মধ্যে আপনার পছন্দ বলুন।
লোথার: আমার পছন্দ মেসি। রোনাল্ডো হচ্ছে, এমন কিছু একটা করে দেবে, আপনি হঠাৎ করে আনন্দ পাবেন। কিন্তু মেসি আপনাকে দীর্ঘ সময় ধরে আনন্দ দেবে। ড্রিবল করতে করতে অনেকটা সময় ধরে দৌড়বে। ওর খেলার স্টাইল মনে অনেকটা সময় ধরে রেশ রেখে দেয়। রোনাল্ডো সেখানে সব কিছুই তাৎক্ষণিক।
প্রশ্ন: কিন্তু চারবার বিশ্বজয়ী জার্মানির এরকম অবস্থা কেন? গ্রুপ পর্যায় পর্যন্ত টপকাতে পারছে না?
লোথার: দেখুন, প্রতিভার অভাব আছে বিশ্বাস করি না। বিশ্বের সেরা দলগুলিতে সবাই খেলছে। তারমানে ভালো ফুটবলারের অভাব নেই। অভাব রয়েছে, ইচ্ছাশক্তিতে। প্যাশনে। ভালো কিছু করার বাসনায়। সব আছে। কিন্তু সব কিছুকে একসূত্রে বাঁধার কেউ নেই।
প্রশ্ন: মানে, আপনি কোচ ‘কাইজার’ বেকেনবাওয়ারকে মিস করছেন?
লোথার: একদম। উনি তো শুধু কোচ ছিলেন না। আমার জন্য দ্বিতীয় বাবা। ওরকম ব্যক্তিত্ব, ফুটবলের প্রতি প্যাশন। এরকম আর পাওয়া যাবে না।
প্রশ্ন: ভারতীয় ফুটবল সম্পর্কে কোনও ধারণা আছে?
লোথার: সত্যি বলতে, একদম নেই। দেখুন, ফিফা ক্রমতালিকায় অনেক পার্থক্য। ভারতীয় ফুটবল নিয়ে ধারণা থাকা সম্ভব নয়। আমার শুধু একটাই অবাক লাগে। দেশের এত জনসংখ্যা, সেরা ১১ জন ফুটবলার খুঁজে পাওয়া যায় না? ভারতীয় ফুটবলের সিস্টেমটা বদলাতে হবে। দরকার এমন বিদেশি কোচ, যিনি এখানকার কোচদের আগে কোচিং দেবেন। ক্লাসে ভালো শিক্ষণ না হলে, ভালো ছাত্র তৈরি হবে কী করে? আগে এখানকার কোচরা ফুটবলে শিক্ষিত হোন। তারপর ফুটবলাররা ঠিকঠাক শিখবেন। দয়া করে সিনিয়রদের ভুলে জুনিয়র ডেভলপমেন্টে আগে নজর দিন।
