গৌতম ব্রহ্ম ও অভিরূপ দাস: দীর্ঘ এক যুগ পর এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। বিলম্বিত বোধোদয় বলাই অবশ্য ভাল। রাজ্যের বনদপ্তর অবশেষে সাপ ধরার (Snake catcher) এবং তা থেকে বিষ সংগ্রহের অনুমতি দিল। একটি বেসরকারি সংস্থাকে আপাতত এক বছরের জন্যে শর্তসাপেক্ষে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে কেউটে, গোখরো, কালাচ, চন্দ্রবোড়া – এই চার প্রজাতির সাপ কেবল ধরা যাবে। পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্যদপ্ততরকে চিঠি লিখে রাজ্যের বনদপ্তর এই খবর জানিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সাপ ধরে রাখতে হবে সর্পঘরে। প্রতিটি সাপের জন্য আলাদা এনক্লোজার (Enclosure)। সাপের বিষ বের করে তা সরবরাহ করতে হবে অ্যান্টিভেনাম (Anti-venom) প্রস্তুতকারী সংস্থার হাতে।
১২ বছর আগের কথা। সাপের বিষ সংগ্রহ বন্ধ করে দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের বনদপ্তর (Forest department)। এতে ফল হয়েছিল মারাত্মক। সাপে-কাটা রোগীদের জন্য যে ওষুধ বা ‘অ্যান্টিভেনাম’ তৈরি হয়, তাতে রাজ্যের বিষধর সাপেদের বিষের পরিমাণ শূন্য হয়ে গিয়েছিল। ফলে খাতায় কলমে অ্যান্টিভেনাম থাকলেও তা পশ্চিমবঙ্গে সাপের কামড় খাওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে সেভাবে কার্যকর হচ্ছিল না। সাপের কামড়ে মারা পড়ছিলেন বাংলার অগুনতি মানুষ। বহুবার বনদপ্তরের কাছে দরবার করেছেন এ রাজ্যের সর্প বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা। শেষমেশ এহেন সিদ্ধান্ত বনদপ্তরের।
[আরও পড়ুন: মহাকাশে সবাইকে টেক্কা দিতে মরিয়া রাশিয়া, পাঁচ বছরের মধ্যেই বানাবে নতুন স্পেস স্টেশন]
তবে সাপ ধরার কিছু নিয়ম বেঁধে দিয়েছে বনদপ্তর। তা নিয়েই বেধেছে বিতর্ক। বনদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি সাপকে ৪৫ দিনের বেশি বাক্সবন্দি করে রাখা যাবে না। তাদের প্রকৃতির মাঝে ছেড়ে দিতে হবে। তাদের প্রশ্ন, একটা কেউটে ৪৫ দিন পর ছেড়ে দিয়ে, ১০ দিনের মধ্যে আরও একটা বিষধর জোগাড় করা কার্যত অসম্ভব। তা খরচসাপেক্ষ। এর প্রভাব পড়বে অ্যান্টিভেনামের দামে।
নির্দেশ রয়েছে আরও। যে চার প্রজাতির সাপ ধরতে বলা হয়েছে, সেই সবকটিই দক্ষিণবঙ্গে অতি পরিচিত। পোড়ো বাড়িতে, ঝোপেঝাড়ে হামেশাই এদের দেখা মেলে। কিন্তু উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি এলাকায় এরা বিরল। সেখানে বরং শাঁখামুটির দৌরাত্ম্য বেশি। সেখানে এমন তিন প্রজাতির বিষধর সাপ আছে যা বনদপ্তরের এই সাপের তালিকায় নেই। বাংলার সর্প বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই চার সাপের বিষ থেকে যে অ্যান্টিভেনাম তৈরি হবে তা উত্তরবঙ্গের ফণাধরদের বিষের মাত্রা কমাতে অপারগ।
প্রতিটি প্রজাতির ১০০টি করে সাপ ধরতে পারবে বেসরকারি সংস্থা। বিপুল এই সংখ্যা নিয়ে চোখ কপালে তুলেছেন সর্পবিশেষজ্ঞ বিশাল সাঁতরা। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অন্যান্য প্রাণীর মতো সাপের ভূমিকাও অপরিসীম। বিশাল সাঁতরার কথায়, “প্রতিটি প্রজাতির ১০০টি করে সাপ ধরার অনুমতি দিয়েছে বনদফতর। অ্যান্টিভেনাম তৈরি করার জন্য এত সাপ ধরার প্রয়োজন কী?” রাজ্যের ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় বিষধর সাপের বিষের চরিত্রও ভিন্ন ভিন্ন। গবেষণায় প্রকাশ, বর্ধমানে ১০ কিলোমিটার অন্তর কেউটের বিষের চরিত্র পাল্টে যায়। সর্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বনদপ্তরকে স্পষ্ট করতে হবে তারা কোন এলাকা থেকে সাপ ধরার অনুমতি দিয়েছে।
[আরও পড়ুন: কমছে বিচরণ ক্ষেত্র, পৃথিবী থেকে অবিলম্বে হারিয়ে যেতে পারে হাঙর-কোমোডো ড্রাগন!]
বিশাল সাঁতরা আরও বলছেন, বাংলার প্রতিটি জীব ভৌগলিক জোন থেকেই সাপ সংগ্রহ করতে হবে। তবেই শক্তিশালী অ্যান্টিভেনাম তৈরি করা সম্ভব হবে। শুধুমাত্র একটি মাত্র জেলা থেকে সাপ ধরলে তা সম্ভব হবে না। চিঠিতে সেন্ট্রাল জু অথরিটির গাইডলাইনের উল্লেখ করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী একটা কেউটে রাখার জন্য চল্লিশ বর্গমিটার জায়গা রাখতে হবে। বেসরকারি ওই সংস্থাকেও সেটাই রাখতে বলা হয়েছে। কিন্তু দেশের অধিকাংশ চিড়িয়াখানাতেই তা নেই। “তাদের কেন কিছু বলা হচ্ছে না?” প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। বনদপ্তরের সাপ ধরার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সর্পবিশেষজ্ঞ শিবাজি মিত্রও। তাঁর বক্তব্য, রাজ্যের নিজস্ব অ্যান্টিভেনাম তৈরি করার জন্য বনবিভাগের এই অনুমতি যুগান্তকারী। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মনসা বায়োটেক প্রাইভেট লিমিটেডকে অনুমতি দিলেও সরকারের উচিত নজরদারি চালানো।