দেব গোস্বামী, বোলপুর: নেই জমিদার, নেই জমিদারিও। ঐতিহ্যবাহী রায়পুরের জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজো (Gramer Durga Puja) এখন বারোয়ারি দুর্গোৎসব। ছেড়ে যাওয়া ভগ্নদশার জঙ্গলাকীর্ণ প্রাসাদোপম জমিদার বাড়ি অতীতের স্মৃতি আঁকড়ে দাঁড়িয়ে। জমিদারবাড়ির পুজোকে ধরে রেখেছেন গ্রামবাসীরাই। সময়ের অতীতে ফিকে হয়ে গিয়েছে জৌলুস। অবশিষ্ট যা পড়ে রয়েছে, তা খানাখন্দে ভরা ইতিহাস।
শান্তিকেতন আশ্রম প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা ছিল এই রায়পুর জমিদারবাড়ির। ১৮৫৫ থেকে ১৮৬৩ পর্যন্ত নিয়মিত ওই বাড়িতে যাতায়াত ছিল দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের। সিংহবাড়ির সদস্যেরা দেবেন্দ্রনাথকে ‘গুরুদেব’ বলেই মান্যতা দিতেন। তাঁর হাত ধরেই কলকাতার বাইরে ব্রাহ্ম উপাসনার পীঠস্থান হয়ে ওঠে এই বাড়ি। সেখানে চারতলায় দেবেন্দ্রনাথের জন্য একটি ঘরও আলাদা করে সংরক্ষিত ছিল। যখনই রায়পুরে আসতেন সেই ঘরেই থাকতেন দেবেন্দ্রনাথ। জমিদারি বিলুপ্তর সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত দুর্গাপুজোর বনেদিয়ানা। হারিয়ে যাওয়া সেই পুজো এখন বারোয়ারি পুজোর রূপ নিয়েছে। পুজোর স্মৃতি টিকিয়ে রাখতে রাজবাড়ির বাসন্তী মন্দিরে উদ্যোগ নিয়েছেন বংশধরেরা ও গ্রামবাসীরা। রীতি মেনে আজও বাসন্তী মন্দিরে দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হয়। অজয় নদের তীরে আদমপুরই ছিল রাইপুর গড়ে ওঠার পূর্বে ওই এলাকার বাসিন্দাদের বসবাসকারী গ্রাম। অজয়ের বন্যার ফলে আদমপুর ছেড়ে সকলে আরও উত্তরদিকে উঠে আসতে লাগলেন এবং নতুন বসতি স্থাপন করলেন। রায়চৌধুরীরা তৎকালে জমিদার ছিল বলেই নতুন গ্রামটির নাম হয় রায়পুর। আর লালচাঁদের বংশে বিশ্বম্ভর সিংহ বর্ধমানের রাজার থেকে রায় খেতাব পাওয়ায়, আদমপুর পরবর্তীকালে রায়পুর নামে পরিচিতি পায়।
[আরও পড়ুন: তৃতীয়ার ভোরে অঘটন! অগ্নিকাণ্ডে পুড়ল দমদমের পুজোমণ্ডপের বড় অংশ]
জানা যায়, রায়পুর জমিদারবাড়ি ও দুর্গাপুজোর বয়স প্রায় ২৫০ বছর। নথি ঘাঁটলে দেখা যাবে, প্রথম ১৫০ বছর এই বাড়ি বাসযোগ্য ছিল। বর্গী আক্রমণের সমসাময়িক কালে মেদিনীপুর থেকে তিন ছেলে, নিজের পরিবার এবং ১ হাজার তাঁতিকে নিয়ে ভাগ্য অন্বেষণে বোলপুরে বসতি গড়েন জমিদার লালচাঁদ সিংহ। তার ঠিক ৪০ বছর পর, ১৭৮০ সালে লালচাঁদের ছেলে শ্যামকিশোর সিংহ জমিদারবাড়ি তৈরিতে হাত দেন। যে জমির উপর বাড়ি তৈরি হয়, পাঁচটি পুকুর সহ আশপাশে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ বিঘা জমি নিয়ে। সেই সময় বোলপুরে এটাই একমাত্র চারতলা বাড়ি। আক্রমণ থেকে বাঁচতে বাড়ির ভিতরে বানানো হয়েছিল সুড়ঙ্গপথও। আলাদা করে অন্দরমহলও বানানো হয়। কিন্তু বর্তমানে সে সবের লেশমাত্র নেই। ঘরটি এখন প্রায় ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। দেবেন্দ্রনাথ-সহ বহু জ্ঞানীগুণী মানুষের আনাগোনা যেমন ছিল এই বাড়িতেই।বাংলার প্রথম অ্যাডভোকেট জেনারেল এবং তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের জন্মও এই বাড়িতেই, ১৮৬৩ সালে। যাঁর নামে কলকাতায় লর্ড এসপি সিনহা রোডের নামকরণ ও রয়েছে।
পরিবারের সদস্য বাদল সিংহ জানান,”নেই মহারাজারা, নেই জমিদারি প্রথা। তবে পড়ে রয়েছে রাজবাড়ির এই স্মৃতিটুকু। ইতিহাসকে ধরে রাখতেই গ্রামবাসীদের সঙ্গেই দুর্গাপুজোয় অংশগ্রহণ করে সিংহ পরিবার। এখনও পুরনো রেওয়াজ মেনেই হয় যাত্রাপালা। আদি দোলা এবং পুজোয় ব্যবহৃত কিছু জিনিস এখনও রয়েছে। ইতিহাসের বহু স্মৃতি নিয়ে এখনও জেগে রয়েছে রায়পুরের জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজো।” স্মৃতিকে ধরেই গ্রামবাসীদের উদ্যোগেই রীতি মেনে আজও হয়ে আসছে দুগাপুজো। জমিদারি না থাকলেও অটুট দুর্গাপুজোয় জমিদারির রীতি-রেওয়াজ। জমিদার বাড়ির পুজো আজ সর্বজনীন।