shono
Advertisement

মাটি প্রস্তুতির গুণেই ফলতে পারে সোনা, জেনে নিন বর্ষায় পিঁয়াজ চাষের পদ্ধতি

কী ধরনের সার দেওয়া প্রয়োজন?
Posted: 02:30 PM Sep 27, 2023Updated: 02:35 PM Sep 27, 2023

সেপ্টেম্বর পরবর্তী সময়ে রাজ্যে পেঁয়াজের ঘাটতি উল্লেখযোগ্যভাবে পরিলক্ষিত হয়। যা চলে মার্চ মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। ওই সময়ে চাহিদার তুলনায় যোগান কম থাকায় বাজারে পেঁয়াজের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। অথচ কিছু জাত আছে যাকে আমরা বর্ষাকালে চাষ করে শীতের মরসুমের আগে ফসল তুলতে পারি যখন এর বাজার দর বেশ চড়া। স্বাভাবিকভাবে বর্ষার মরসুমে রাজ্যে পেঁয়াজ চাষ করে এই সমস্যা অনেকটা কাটানো যাবে। লিখেছেন বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক তপন কুমার মাইতি। পড়ুন শেষ পর্ব।

Advertisement

জাত
এগ্রিফাউন্ড ডার্ক রেড, এন-৫৩, আর্কা কল্যাণ, আর্কা প্রগতি, আর্কা নিকেতন, বসন্ত ৭৮০, ইত্যাদি।
জলবায়ু
পেঁয়াজ একটি শীতকালীন সবজি হিসাবে জানি। কম তাপমাত্রায় পেঁয়াজ গাছের বৃদ্ধি বা বাড় ভাল হয় এবং তুলনামূলক ভাবে বেশি তাপমাত্রায় ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে কন্দের বৃদ্ধি ভাল হয়। তবে বর্ষার পেঁয়াজের জাতগুলি তুলনামূলকভাবে একটু বেশি তাপমাত্রাতে ভাল হয়। সর্ব্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা যথাক্রমে ২৮-৩৫ এবং ১৪-১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এই সময়ের পেঁয়াজের ফলনের পক্ষে সব থেকে বেশি উপযোগী। তাছাড়া অনেক জাতে কম তাপমাত্রায় (১০-১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস) কলি এসে যায়। যে গাছে কলি বা ফুল এসে যায় তার ফলন কম হয় এবং সেই পেঁয়াজ তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়।
মাটি
এঁটেল মাটি ছাড়া অন্য যে কোনও প্রকার মাটিতে এই পেঁয়াজের চাষ করা যায়। পলি ও দোঁয়াশ মাটি পেঁয়াজ চাষের পক্ষে অনুকূল। বিশেষ করে দোঁয়াশ মাটি এই চাষের পক্ষে ভাল। তবে এঁটেল মাটিতে বেশি পরিমাণে জৈব সার দিয়ে ভাল ফলন পাওয়া যায়। মাটির অল্প অম্লত্ব থাকা দরকার এবং অম্লত্ব ৫.৮-৬.৫ এর মধ্যে থাকলে ফলন বেশি পাওয়া যায়। পেঁয়াজ কিছুটা লবণাক্ত মাটি সহ্য করতে পারে। অম্লত্ব ৭.০ বা তার বেশি হলে কিছু কিছু অনুখাদ্য, বিশেষত ম্যাঙ্গানিজের অভাব দেখা দেয়। অম্লত্ব ৫.৫ এর নীচে থাকলে চুন প্রয়োগে জমি শোধন করতে হবে। পেঁয়াজ লাগানোর আগে জমিকে ভালভাবে চাষ দিয়ে সমতল করে জল ও বাতাস চলাচলের উপযোগী করে নেওয়া দরকার।

[আরও পড়ুন: অযোধ্যা পাহাড়ে ‘আম বিপ্লব’, ‘তাইল্যান্ড বারোমাসী’ প্রজাতিতে সারা বছরই রসনাতৃপ্তি]

বীজ বপন ও চারা তৈরি
বীজ বপনের উপযুক্ত সময় জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি থেকে আষাঢ় মাসের শেষ পর্যন্ত। বিঘা প্রতি বীজের হার ১.০ কেজি। বীজতলার জন্য প্রথমে এমন একটি জায়গা নির্বাচন করতে হবে যেখানে জলনিকাশি ব্যবস্থা ভাল আছে, দিনের বেশিরভাগ সময় সূর্যের আলো পায় এবং বিগত ২-৩ বছরে ওই জায়গায় কোনও বীজতলা তৈরি হয়নি। জল না দাঁড়ানো ও নিকাশি ব্যবস্থাযুক্ত উঁচু জমি বীজতলার জন্য নির্বাচন করাতে হবে। বীজতলার মাটি ভালভাবে কুপিয়ে, পাথর, ইটের টুকরো প্রভৃতি শক্ত জিনিস সমেত আগাছা বেছে নিতে হবে এবং মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। বীজতলার আকার হবে ১০ ফুট ও ৩ ফুট ১/২ ফুট। এক বিঘা জমিতে চারা লাগানোর জন্য আনুমানিক এক কাঠা বীজতলার প্রয়োজন হয়। বীজতলার মাটি শোধনের জন্য ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি মেশানো ২ ঝুড়ি পরিমাণ কম্পোস্ট সার ভালোভাবে ছড়িয়ে দিয়ে, মাটি কুপিয়ে ঝুরঝুরে করতে হবে। তামাঘটিত ওষুধ যেমন ব্লাইটক্স বা ব্লু কপার (৪-৫ গ্রাম প্রতি লিটার জল দিয়ে বীজতলার মাটি ভালভাবে ভিজিয়ে শোধন করা যেতে পারে।

প্রতিটি বীজতলার জন্য ৫০০ গ্রাম অ্যামোনিয়াম সালফেট বা ২২৫ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০০ গ্রাম সুপার ফসফেট ও ২৫০ গ্রাম মিউরিয়েট অফ পটাশ দিতে হবে। বীজতলা তৈরি হলে ২ ইঞ্চি দূরে লাইন করে ১/২ ইঞ্চি গভীরে বীজ বুনতে হবে। বীজ বোনার পর হালকা মাটি বা শুকনো গুঁড়ো জৈব সার দিয়ে বীজকে হালকা ভাবে চাপা দিতে হবে। এরপর শুকনো খড় বা লম্বা ঘাস দিয়ে বীজতলাকে ঢাকা দিয়ে হালকা করে ঝারি করে জল দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে।বর্ষার প্রকোপ থেকে রক্ষা করতে বীজতলার উপর বাঁশের ফ্রেম করে পলিথিন দিয়ে ঢাকা জরুরি। বীজতলার দুই-আড়াই ফুট উপরে পলিথিন চাদরের চালা তৈরি করে নিলে বৃষ্টিতে ক্ষতি তো হয়ই না, অধিকন্ত সূর্যের আলো পলিথিনের ভিতর দিয়ে সহজেই পৌঁছতে পারে বলেই চারাগুলি বেশ সতেজ হয়। প্রথমদিকে রোদ পাওয়ার জন্য রোজ সকালে ও বিকালে ২-৩ ঘন্টা করে বীজতলার ঢাকনা খুলে রাখতে হবে। আস্তে আস্তে চারা যত বড় হবে তত বেশি রোদ খাওয়ানো দরকার। বীজতলা রাতে খুলে রাখতে হবে। বৃষ্টি এলে বীজতলা অবশ্যই ঢেকে দিতে হবে।

রোদ ও শিশির পেলে চারা শক্ত ও সতেজ হবে। ঢাকা প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় রাখলে চারা অযথা লম্বা হবে এবং রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। বীজতলায় রোগের প্রকোপ কমাতে তামা ঘটিত ওষুধ ২-৩ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে ৭-১০ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে। বীজতলায় চারা বেরতে শুরু করলে বীজতলা উপরের খড় বা ঘাস সরিয়ে দিতে হবে। বীজতলার মাটিতে যেন যথেষ্ঠ নরম থাকে সেইভাবে বীজতলাটিকে জল দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে। চারার বয়স এক থেকে দেড় মাসের হলে মূল জমিতে লাগাতে হবে। কম বয়সের চারা লাগালে অনেক চারা মরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার বেশি দিনের চারা লাগালে, গাছের ভাল বৃদ্ধি না হওয়ার আগে কলি এসে যাবে।
জমি তৈরি ও চারা রোপণ
খরিফ মরশুমে পেঁয়াজ চাষের জন্য জল না দাঁড়ায় এমন উঁচু জমি নির্বাচন করা প্রয়োজন। জমিটিকে ভালভাবে চাষ দিয়ে তাতে ২৪০ টন গোবর সার ও রাসায়নিক সার মিশিয়ে ১.৫ মিটার অন্তর ৫০ সেমি চওড়া জল নিকাশি নালা করতে হবে। এর ফলে জমিটিতে ১.৫ মিটার চওড়া কয়েকটি ফালি তৈরি হবে। চারা লাগানোর সময় দুটি সারির মধ্যে দূরত্ব ৬ ইঞ্চি (১৫ সেমি) আর সারিতে দুটি গাছের মধ্যে দূরত্ব ইঞ্চি (১০ সেমি) রাখতে হবে।
সার প্রয়োগ
জমি তৈরির সময় ২.৫ থেকে ৩ টন কম্পোস্ট বা গোবর সার ভালভাবে মিশিয়ে ২-৩ বার চাষ দিতে হবে। লাগানোর সময় মূল সার হিসাবে বিঘা প্রতি ৮-১০ কেজি নাইট্রোজেন, ৮-১০ কেজি ফসফরাস, ৭-৮ কেজি পটাশ ও ৫-৬ কেজি সালফার দিতে হবে। চাপান সার হিসাবে বিঘা প্রতি ৮-১০ কেজি নাইট্রোজেন এবং ৭-৮ কেজি পটাশ দুভাগে চারা লাগানোর ২১ ও ৪৫ দিন পরে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। চাপান সার অবশ্যই চারা লাগানোর দুমাসের মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে। পরে দিলে পেঁয়াজের গলা মোটা হয়ে যায়, ফলে কন্দ শুকাতে অনেক সময় লাগে। তাছাড়া কন্দ দুটি ভাগ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অনুখাদ্য প্রয়োগে পেঁয়াজের ফলন গুণগতমান ভাল হয়। জিঙ্ক সালফেট ২.৫ গ্রাম এবং বোরাক্স ১.৫ গ্রাম হিসাবে প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে ৩০ ও ৬০ দিন পরে স্প্রে করতে হবে। এই সময় বিঘা প্রতি ৩-৩.৫ কেজি কার্বোফিউরান (ফিউরাডন) বা ১-১.৫ কেজি ফোরেট (থাইমেট) দিলে অনেক কীটশত্রুর আক্রমণ হবে না।
আগাছা দমন
পেঁয়াজের শিকড় খুব গভীরে যায় না। সেজন্য জমির আগাছা দমনে বিশেষভাবে নজর দেওয়া দরকার। বিশেষ করে ফসলের প্রথমের দিকে ভালভাবে জমিকে আগাছামুক্ত রাখতে হবে। হালকাভাবে নিড়ানি দিয়ে আগাছা তুলে ফেলতে হবে যাতে কন্দের কোনও ক্ষতি না হয়। আগাছানাশক ঔষধ ব্যবহার বর্তমানে লাভজনক। আগাছানাশক ঔষধ হিসাবে অক্সিফ্লুরোফেন ২৩.৫ শতাংশ এআই চারা লাগানোর আগে এবং ৪৫-৬০ দিন পরে হালকাভাবে নিড়ানি দিয়ে আগাছা তুলে ফেলতে পারলে, জমিতে আগাছার সমস্যা যেমন থাকবে না তেমন ফলনও বেশি পাওয়া যাবে। তাছাড়া চারা লাগানোর সময় পেন্ডিমেথালিন ৩০ শতাংশ এআই ও কুইজালোফপ ইথাইল ৫ শতাংশ এআই এবং একই মিশ্রণ আবার ৩০ দিন পরে জমিতে প্রয়োগে ভাল ফল পাওয়া যায়।
জলসেচ
বর্ষার মরশুমে সেচের খুব একটা দরকার হয় না। বৃষ্টির অভাব হলে মাটিতে যাতে রস থাকে সেভাবে সেচের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ফসল তোলার ১০ দিন আগে কোনও সেচ দেওয়া চলবে না।
ফসল তোলা
শীতকালের পেঁয়াজের মত বর্ষার পেঁয়াজের পাতা তোলার আগে সম্পূর্ণ হলদে ও শুকিয়ে যায় না। জাত অনুসারে চারা লাগানোর ১১০-১৩০ দিনের মধ্যে ফসল তোলার উপযুক্ত হয়। পাতার কিছু অংশ হলুদ হলে পেঁয়াজ তোলা যেতে পারে। ফসল তোলার ১৫-২০ দিন আগে ১০ শতাংশ সাধারণ লবণ স্প্রে কেরলে পেঁয়াজের পাতা নেতিয়ে পড়ে অতিরিক্ত জলীয় অংশ বেরিয়ে যায়। এতে পেঁয়াজের কন্দ তাড়াতাড়ি শুকনো হতে সাহায্য করে এবং কন্দের রঙ উজ্জ্বল হয়। পেঁয়াজের মধ্যে অতিরিক্ত রস কমানোর জন্য গাছ সমেত কন্দগুলিকে ৩ দিন জমিতে শুকিয়ে নিতে হবে।
ফলন
জাত অনুসারে বিঘা প্রতি গড় ফলন ২৫-৩০ কুইন্ট্যাল।

[আরও পড়ুন: স্বাদ-গন্ধ সামান্য কম হলেও ফলনে এগিয়ে, বাসমতী চালের স্থান নিতে চলেছে হুগলির চুঁচুড়ামতী]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement