সুলয়া সিংহ: ‘আমাকে ভাবায়, সুকুমার রায়…’ – বাঙালির সংস্কৃতির মর্মকথা অমোঘ সুরে বেঁধে দিয়েছিলেন নাগরিক কবিয়াল। সেই ভাবনারই ছায়াপাত এবার বাংলার সংস্কৃতির সেরা উদযাপনে। সুকুমারীয় জগতেই এবার সেজে উঠছে হাতিবাগান নবীন পল্লির শারদোৎসব।
বাঙালির দুর্গাপুজোর সঙ্গে সুকুমার-বন্ধন সেভাবে এর আগে দেখা যায়নি। তবে এই বছরটার মাহাত্ম্যই যে অন্যরকম। সুকুমার রায়ের অমর সৃষ্টি ‘আবোল তাবোল’-এর এটি শতবর্ষ। রামগরুড়ের ছানা কিংবা হুঁকোমুখো হ্যাংলাদের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় সেই শৈশবেই। বয়স যত বাড়ে সে সব চরিত্রের মাত্রা বদলে যায়। ছোটবেলার বোঝা না-বোঝার যে অনাবিল আনন্দের জগৎ যে কতখানি সামাজিক বার্তাবহ, আমরা ক্রমে তা অনুধাবন করি। শৈশব তাই ফুরিয়ে যায়, সুকুমার ফুরোন না। একশো বছর পেরিয়েও ‘আবোল তাবোল’ বাঙালি সাংস্কৃতিক মানচিত্রে শুধু প্রাসঙ্গিক নয়, অনিবার্য দিকচিহ্ন হয়েই থেকে যায়। সেই সঙ্গে সুকুমারের প্রয়াণেরও এটি শতবর্ষ। অতএব বাঙালি যদি তাঁর সাংস্কৃতিক উদযাপনে মাতে, তবে সুকুমার-স্মরণ অবধারিত হয়ে ওঠে। সেই ভাবনা থেকেই সুকুমার-উদযাপনের আয়োজন উদ্যোক্তাদের।
‘আবোল তাবোল’ প্রকাশের বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছিল, ‘ছেলেমেয়েদের পূজার উপহারের এমন বই আর নাই।’ একশো বছরে সেই পুজোর উপহার হয়েই যেন ফিরে এল ‘আবোল তাবোল’।
[আরও পড়ুন: মাদক বিরোধী অপারেশনের নেতা, RAW অফিসার, কে কানাডায় বহিষ্কৃত ভারতীয় কূটনীতিক?]
তবে বইয়ের পাতা থেকে কল্পনার জগৎকে সুকুমারের ভাবনাবিশ্বকে বাস্তবে মূর্ত করে তোলা চাট্টিখানি কথা নয়। সেই চ্যালেঞ্জই নিয়েছেন শিল্পীরা। এবার নবীন পল্লির সামগ্রিক সৃজনের দায়িত্ব শিল্পী অনির্বাণ দাসের। আলো-আঁধারির খেলায় ‘আবোল তাবোল’-এর মজা জমিয়ে দেবেন আলোকশিল্পী প্রেমেন্দু বিকাশ চাকী। পরিকল্পনা আছে, লাইট-সাউন্ডের মাধ্যমে সুকুমার-পৃথিবীকে ভাস্বর করে তোলার। শুধু তাই নয়, যে প্রেস থেকে ১৯২৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রথমবার ‘আবোল তাবোল’ ছাপা হয়েছিল, সেই ইউ রে অ্যান্ড সন-এর প্রেসটিরও দেখা মিলতে পারে মণ্ডপে। সবমিলিয়ে আবোল তাবোল-এর পাতায় পাতায় যে অভূতপূর্ব পৃথিবীর ডাক, তারই সাক্ষী থাকবেন দর্শনার্থীরা। মুখ্য আয়োজক দীপ্ত ঘোষ জানাচ্ছেন, মূল পুজোর সঙ্গেই একাত্ম হয়ে যাবে সুকুমারের চরিত্ররা। অর্থাৎ যা ছিল ছড়ার ভিতর, তাই-ই চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠবে। সেই সঙ্গে মাতিয়ে রাখবে সুকুমারের আশ্চর্য ছন্দ।
এ-কথা ঠিক যে আজকের শৈশব অনেকখানি বদলে গিয়েছে। এখন যারা মা-বাবার হাত ধরে পুজো দেখতে যায়, তারা হয়তো অনেকেই সুকুমার রায়ের এইসব চরিত্রদের সঙ্গে পরিচিত নয়। সামগ্রিক ভাবে বাঙালির বই পড়ার অভ্যাসও কমেছে। উদ্যোক্তাদের আশা, এই সুকুমার-সেলিব্রেশন শুধু পুজোর পরিধিতে যেন আটকে না থাকে। তা যেন নতুন প্রজন্মের বাঙালির কাছে হয়ে ওঠে সুকুমার-হাতেখড়ি। আলো-ছায়ার মায়ায় সুকুমারীয়-ভুবনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে যদি কেউ বাড়ি ফিরে ‘আবোল তাবোল’-এর পাতা ওলটায়, তবে মন্দ কী! বাঙালির পুজো বরং এভাবেই এবছর হয়ে উঠুক সুকুমার-উৎসব।