রাতারাতি ওজন কমাতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনছেন না তো? আজকাল না জেনেবুঝে অনেকেই নানা ওষুধ অথবা সাপ্লিমেন্টে ভরসা রাখেন। চিত্তাকর্ষক চেহারা পেতে এই পথ বেছে নেওয়ায় ঘোরতর আপত্তি জানিয়ে ক্ষতির কথা তুলে ধরলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ফার্মাকোলজিস্ট ডা. অঞ্জন অধিকারী। শুনলেন সুমিতা ভাস্কর।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একটা ঘটনা ঘটেছিল। হিটলারের নাৎসি বাহিনী যুদ্ধবন্দিদের যে শুধু ডিটেনশন ক্যাম্পেই নিয়ে গিয়ে আটকে রাখত বা শারীরিক নিগ্রহ করত তা-ই নয়, তাঁদের উপর নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালাত। তার প্রায় পুরোটাই চিকিৎসা সংক্রান্ত। শুনতে কিছুটা অদ্ভূত লাগলেও এটা ঘটেছিল। এই সমস্ত বন্দিদের খাবার কমিয়ে-বাড়িয়ে পরীক্ষা করা হত, শরীরে ঠিক কতটা পরিমাণ খাদ্য গেলে এবং কতটা সময় বিনা খাদ্যে থাকলে শরীর কীরকমভাবে রিঅ্যাক্ট করে। কার্যত তাঁদের গিনিপিগের মতো ব্যবহার করে তাঁদের উপর খাবার খাওয়া-না খাওয়ার প্রভাব পরীক্ষা করে দেখত নাৎসিরা। এমনকী, এতে কাজের ক্ষমতা কতটা বাড়ছে বা কমছে, পরীক্ষা করা হত সেটাও। নানা রকম অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মতো নতুন চিকিৎসা পদ্ধতিও মকশো করা হয়েছে সেই সময়ে। বলাই বাহুল্য এই সমস্ত পরীক্ষার সময় বন্দিদের কোনও সম্মতি নেওয়া হত না!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সময় এগিয়েছে আট দশক। কিন্তু এই পরীক্ষা পদ্ধতি কিন্তু বদলায়নি। বদলেছে শুধু পরীক্ষক। চতুর্দিকে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে নানা ক্লিনিক কিংবা হেলথ কেয়ার সেন্টার। যারা নানা আজব ওষুধ খাইয়ে রাতারাতি ওজন কমানোর টোপ দিচ্ছে মানুষকে। বহু মানুষ ছুটছেনও সেখানে। গাঁটের কড়ি খরচ হচ্ছে অনেকটাই। অথচ লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না। উলটে শরীরে আরও কিছু বাড়তি অসুস্থতা যোগ হচ্ছে। এমনকী, ঘটছে প্রাণহানিও। যার নেপথ্যে রয়েছে ক্র্যাশ ডায়েট।
ক্র্যাশ ডায়েটে হেড ক্র্যাশ!
ক্র্যাশ ডায়েট। এই শব্দটা গত কয়েক বছরে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটা অংশ হয়ে গিয়েছে।কাগজে কিংবা টেলিভিশনে কিংবা সোশাল মিডিয়ায় এমন বিজ্ঞাপন আমরা হামেশাই দেখতে পাই যেখানে রাতারাতি রোগা করে দেওয়ার নানা গল্প শোনানো হয়। দেখানো হয় নানা চমকদার প্রলোভনও। বর্তমানে লাইফস্টাইলের কারণেই সব বয়সের মানুষের মধ্যেই বেশি ওজনের প্রবণতা দেখা যায়। এর একটা বড় কারণ অবশ্যই সেডেন্টারি লাইফ অর্থাৎ যেখানে শারীরিক কসরত করার প্রবণতা এবং প্রয়োজন কমে যাওয়া। ফল, ওজন বৃদ্ধি। আর সেই ওজনকেই রাতারাতি কমিয়ে দিতে টোপ দেওয়া হয় ক্র্যাশ ডায়েট থেকে প্রোটিন শেক, কখনও নো কার্ব ডায়েট আবার কখনও স্কিপ মিল ডায়েটের।
একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, রাতারাতি কোনও ম্যাজিক ঘটে না। আর যে সমস্ত চটজলদি হাতেগরম উপায়ের কথা এই সমস্ত তথাকথিত স্লিমিং সেন্টার কিংবা অনলাইন পোর্টাল কিংবা অ্যাপ, অনলাইন গ্রুপ ধরিয়ে দেয় এর কোনওটিই প্রকৃত অর্থে প্রমাণিত কোনও প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি নয়। অনেক সংস্থা আবার আয়ুর্বেদিক নানা ওষুধ খাইয়েও মিরাকল ঘটানোর দাবি করেন। তারও কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এখনও পর্যন্ত মেলেনি।
খুব বুঝে ডায়েট প্ল্যান
আসল কথা হল, যে পদ্ধতিই নেওয়া হোক না কেন, তার সঙ্গে প্রয়োজন কনস্ট্যান্ট মেডিক্যাল সুপারভিশন। কোনও চিকিৎসকের পরামর্শ এবং তাঁর তত্ত্বাবধান ছাড়া কোনওভাবেই কোনও ডায়েট প্ল্যান ফলো করা উচিত নয়। আরও জরুরি বিষয় হল এই যে প্রথমবার চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কোনও ডায়েট প্ল্যানে চলে যাওয়ার পর সেটাকেই অন্ধের মতো অনুসরণ আরও ভয়ানক হতে পারে। কারণ আমাদের প্রত্যেকের শরীরই নিত্য পরিবর্তনশীল। কোনও ডায়েট শুরুর আগে এবং তা ব্যবহার শুরু করার পর শরীরে যে বদল হবে তার সঙ্গে ডায়েটও কতটা পালটে যাবে সেটার উপর নজর রাখাও অনেক বেশি প্রয়োজন।
একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের গড়ে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার কিলো ক্যালরি শক্তি জোগান দেওয়া খাদ্যের প্রয়োজন হয়। কিছু বিশেষ কারণে তার থেকে কম বা বেশি হতে পারে কিন্তু এটাই মোটামুটি স্বাভাবিক প্যারামিটার। অনেক সংস্থাই তাদের ক্র্যাশ ডায়েট মিল প্ল্যান করতে গিয়ে ক্রমেই প্রতিদিনের ক্যালোরির ইনটেকের পরিমাণ কমিয়ে দিতে থাকে। তবে যে ডায়েট প্ল্যানই দেওয়া হোক না কেন সেখানে প্রোটিন থাকবে কিছুটা বেশি। ফ্যাট আর কার্বোহাইড্রেট থাকবে অতি সামান্য মাত্রায় কিংবা একেবারেই থাকবে না। কিন্তু যে জিনিসটা খেয়াল রাখা দরকার, আমাদের প্রত্যেকের শরীরে প্রতিটি ধরনের পুষ্টিগুণই প্রয়োজন। এবং নিয়ন্ত্রিত মাত্রায়। সেখানে ফ্যাটও যেমন প্রয়োজন তেমনই প্রয়োজন কার্বোহাইড্রেট।
তবে ক্র্যাশ ডায়েটে যেটা দেখা গিয়েছে গড়ে প্রতিদিন আটশো ক্যালরির খাবার খেলে সপ্তাহে প্রায় দুই থেকে তিন কিলো মতো ওজন কমতে পারে কোনও ব্যক্তির। মানুষ বিশেষে কারও ক্ষেত্রে তা কিছুটা কম কারও ক্ষেত্রে বেশি। এতে যেটা দেখা যায় দু’-তিন মাসের মধ্যে ওই ব্যক্তির আট-দশ-বারো কিলো ওজন কমে যাচ্ছে ঠিকই, কিংবা ফ্যাট থেকে যে ধরনের সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে সেগুলোও কমে যাচ্ছে পাল্লা দিয়ে, কিন্তু অন্য সমস্যা মাথাচাড়া দিচ্ছে।
শুধু প্রোটিনে জোর নয়
তবে শুধুই প্রোটিনের উপর জোর দিতে গিয়ে যেটা নিশ্চিতভাবেই দেখা যায় তা হল শরীর অত্যধিক দুর্বল হয়ে পড়া। এছাড়াও শরীরের ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালান্স তৈরি হয় প্রবলভাবে যার অসম্ভব নেতিবাচক দিক রয়েছে। রক্তচাপে এর প্রভাব পড়ে। কারও পেশি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। কারও হাড় অত্যন্ত ভঙ্গুর হয়ে যায়। কারও প্রবল কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। প্রায় সকলেরই চামড়া কুঁচকে ঝুলে পড়ে। আসলে শরীরে জমা ফ্যাট গলিয়ে শরীর ওই ক্র্যাশ ডায়েটের সময়ে নিজের প্রয়োজনীয় এনার্জির জোগান নিয়ে নেয় বটে কিন্তু কতক্ষণ পর্যন্ত সেই ফ্যাট গলানো এনার্জি শরীর নিতে পারবে সেটা শুধুমাত্র একজন চিকিৎসকই বলতে পারবেন।
আসলে আমাদের সকলের শরীরই এক ধরনের ডায়েটে দীর্ঘদিন ধরে অভ্যস্ত। হঠাৎই তাকে চেনা নিয়ম ভেঙে নতুন ছাঁদে ঢালতে চাইলে শরীর তা গ্রহণ করবে না। আর তাতেই ঘটে বিভ্রাট। কোনওরকম তত্ত্বাবধান ছাড়া এমন ডায়েটে চলে গেলে প্রাণহানিও অস্বাভাবিক কোনও ঘটনা নয়। সম্প্রতি এমন বেশ কিছু খবর আমাদের নজরে এসেছে। যার কারণ নিশ্চিতভাবেই কোনও রকম সুপারিভশন ছাড়া ইচ্ছে মতো এবং ‘হাতুড়ে বিশেষজ্ঞদের’ ভরসায় এমন প্রাণঘাতী ডায়েট করে নিজের বিপদ বাড়ানো।
তা হলে কী করবেন?
তা হলে কি এই ক্র্যাশ ডায়েট বা সেমি স্টারভেশনাল ডায়েট কি একেবারেই ত্যাজ্য? পুরোপুরি নয়। কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে, তা কোনও অস্ত্রোপচার হতে পারে কিংবা বিশেষ কোনও ট্রিটমেন্ট– তার জন্য স্বল্প কিছু সময় এমন ক্র্যাশ ডায়েট ফলো করা যায়। তবে ক্র্যাশ ডায়েট দীর্ঘ সময়ের জন্য নয় কখনওই। আর নিশ্চিতভাবেই সেটা চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ও নজরদারিতে। তাই আট দশক আগের নাৎসিদের হাতের গিনিপিগ হতে চাইবেন, না কি কসরত করে এবং প্রপার চিকিৎসার মাধ্যমে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে আনতে চেষ্টা করবেন, সেটা আপনারই হাতে। পেশি আর ফ্যাট নিয়ন্ত্রণে আনতে অন্যান্য অঙ্গের ক্ষতি করবেন কি না সেই সিদ্ধান্ত একান্তই আপনার।