প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করে মা হওয়া সোজা কথা নয়। আজকাল তো এই ব্যথার ভয় এড়াতে সিজারিয়ান সেকশনে ঝোঁক বাড়ছে। কিন্তু গবেষণার তথ্য, ভ্যাজাইন্যাল ডেলিভারির বিকল্প কিছুই হতে পারে না। এ ব্যথা সুখকর অনুভূতি আর প্রীতিকর। পাশ্চাত্য দেশগুলির মতো আগামীতে এ রাজ্যেও নর্মাল ডেলিভারি আগের মতোই স্বাভাবিক হতে পারে। তবে নানা দিক বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে বলছেন গাইনোকলিস্ট ডা. ইন্দ্রনীল সাহা।
মা হওয়ার অনুভূতি বিশ্বের সেরা অনুভূতি। এই মুহূর্ত প্রত্যেক মায়ের জীবনেই আজীবন রয়ে যায়। কিন্তু সুখের এই মুহূর্তকে আরও সুখকর করতে অনেকেই চান নর্মাল ডেলিভারি করতে। এই নর্মাল ডেলিভারি আসলে চিকিৎসা পরিভাষায়, ভ্যাজাইন্যাল ডেলিভারি। যদিও পাশ্চাত্য দেশে এই ন্যাচারাল প্রক্রিয়াতেই জোর বেশি। এমনকী, এদেশের কিছু অংশে বিশেষত উত্তর ও দক্ষিণ এই প্রক্রিয়াতেই মা হওয়ার পথে হাঁটেন অধিকাংশই। কিন্তু এ রাজ্যের চিত্রটা আলাদা। সিজারিয়ান সেকশনের প্রবল চাহিদা।
গবেষণার তথ্য জানলে আরও আশ্চর্য হবেন। তথ্য বলছে গর্ভবতী মহিলাদের ৮৫ শতাংশই সাধারণ প্রসব অর্থাৎ নর্মাল ডেলিভারির মাধ্যমে সন্তান প্রসবে সক্ষম। পড়ে থাকা ১৫ শতাংশের অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন পড়লেও পড়তে পারে। কিন্তু হিসাব বলছে, প্রতি তিনজন গর্ভবতী মহিলার ভিতর একজনের সি-সেকশন হচ্ছে ইদানীং। এই ট্রেন্ডটা ভাঙা দরকার। কারণ যা কিছু স্বাভাবিক সেটা সবসময়ই স্বাস্থ্যকর। কিন্তু একটা ভয় কাজ করে, কিছু যদি হয়ে যায়। সময় এসেছে ভয় ভাঙার। মা হওয়ার অনুভূতি হোক আরও প্রীতিদায়ক।
সত্যিই কি ঝুঁকির, নর্মাল ডেলিভারি?
এটা অনেকটা মানসিক ব্যাপার। মনের জোর লাগে এই সিদ্ধান্ত নিতে। কিছু জিনিস রয়েছে নর্মাল ডেলিভারিতে। যেমন, কখন ব্যথা উঠবে, এমার্জেন্সি কখন হবে, এগুলো নিয়ে চিন্তা থাকে। তার পাশাপাশি ফরসেপ ডেলিভারি অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলেও অনেকেরই ধারণা রয়েছে। সদ্যোজাতর কিছু হয়ে গেলে? এছাড়া এরাজ্যে নর্মাল ডেলিভারির জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামোরও অভাব রয়েছে। তাই অনেকে চাইলেও এই পথে হাঁটতে ভয় পান।
প্রসূতির যখন লেবার পেন শুরু হয় তখন গর্ভস্থ শিশুর হার্টবিট প্রতিনিয়ত দেখতে হয়, আরও আনুষঙ্গিক ব্যাপারে নজর দিতে হয়। এটা খুব জটিল একটা প্রক্রিয়া। এর জন্য যথাযথ পরিকাঠামো খুব জরুরি। পেনলেস লেবার বা এপিডিউরাল ইনজেকশন প্রয়োগের দ্বারা ব্যথাবিহীন লেবার ও তার পর সন্তানের প্রসব এখন উন্নত একটি পদ্ধতি। এদেশে তথা এরাজ্যে এখনও এই উপায়ে মা হওয়ার ঘটনা বেশ কম। পাশাপাশি চিকিৎসকদেরও অনেক চিন্তা থাক। একটু কিছু হলে তাঁদের দুষবেন পরিবারের লোক। তাই অনেকেই এসব ঝামেলা এড়িয়ে সিজারকেই নিরাপদ মনে করেন।
তবে বিজ্ঞান বলছে, স্বাভাবিক নিয়মে যে পথে সন্তান প্রসব হয় সেটাই কিন্তু মা ও সন্তান দুয়ের জন্যই স্বাস্থ্যকর। পাশ্চাত্য দেশে সিস্টেম খুব ভালো। অর্থনৈতিক দিক থেকে সরকার পুরোপুরি সাহায্য করে বলে সবরকম সুবিধা এখানে রয়েছে। ফলে নর্মাল ডেলিভারির জটিলতা এদেশে নেই।
[আরও পড়ুন: প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা জুটির পঞ্চাশতম ছবি কতটা সুযোগ্য? পড়ুন ‘অযোগ্য’র রিভিউ]
সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মাথায় রাখুন
গর্ভবতীর যদি কোনও রকম শারীরিক জটিলতা না থাকে। যেমন, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত, ব্লাড সুগার ঠিক আছে, গর্ভস্থ শিশুর ওজন, সাইজ ও পজিশন ঠিক থাকলে মা নর্মাল ডেলিভারির সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
যে হাসপাতালে ডেলিভারি করাবেন দেখে নিতে হবে যেন সব রকম পরিকাঠামো বর্তমান থাকে।
আগের প্রেগন্যান্সি সিজার করে হলে, তার পরেরটা ভ্যাজাইনাল ডেলিভারি করা যায়, কিন্তু আগে দুবার সিজার হলে তার পরেরটা সিজারই করতে হয়।
শারীরিক ভাবে সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতাও দরকার। কারণ প্রসবের সময় মা-কেই প্রেশার দিয়ে বাচ্চাকে পেট থেকে বের করতে হয়। এর জন্য মানসিকভাবে অনেক বেশি দৃঢ় হওয়া দরকার।
শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতির জন্য গর্ভাবস্থায় নিয়মিত পেলভিক ফ্লোর এক্সারসাইজ করা দরকার। সবশেষে, চিকিৎসকের সিদ্ধান্তই শেষ কথা।
ছবি: প্রতীকী
যে যে জটিলতা দেখা দিতে পারে
এর পাশাপাশি শারীরিকভাবে কিছু জটিলতা থাকলে হঠাৎ করে নর্মাল ডেলিভারির সময় এমার্জেন্সি সিজার করার প্রয়োজন হলে সেটা চাপের ব্যাপারই হয়।
শিশুকে ফরসেপ দিলে মায়ের ভ্যাজাইন্যাল টিয়ার হয়ে যেতে পারে, ফলত রক্তপাত বেশি হয়। পরবর্তীকালে মায়ের প্রস্রাবের বেগ ধরে রাখতে সমস্যা হতে পারে। অনেক সময় বেশিক্ষণ লেবার চললে মায়ের পোস্টপার্টম হেমারেজ হয়। ইউটেরাস থেকে রক্তক্ষরণ বেশি হয়।
এই সব রিস্ক থাকা সত্ত্বেও বলব, এই পদ্ধতি অনেক বেশি স্বাস্থ্যসম্মত। পরিকাঠামোর দিকে থেকে এরাজ্য খুব যে পিছিয়ে আছে এটাও বলা যায় না। বর্তমানে সরকারি হাসপাতালে নর্মাল ডেলিভারি খুব হয়। বেসরকারি হাসপাতালেও সুবিধা রয়েছে। অমূলক ভয় না পেয়ে, পিছিয়ে না এসে সব বুঝে সিদ্ধান্ত নিলে মা হওয়া মুখের কথা নয় ঠিকই, জীবনের সেরা কাহিনি।
ভালো দিকও রয়েছে
কেন এপথে হাঁটবেন? নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও একবার ভেবে দেখার সময় এসেছে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে সময় কম। অপারেশন পরবর্তী জটিলতা কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে যত তাড়াতাড়ি প্রবেশ করা যায় ততই ভালো, সেদিক থেকে তাই ভ্যাজাইনাল ডেলিভারি অনেক বেশি নিরাপদ। এই পদ্ধতিতে শিশুর সঙ্গে মায়ের বন্ডিং খুব ভালো হয়। শিশু ফুসফুস খুব ভালো থাকে এই পদ্ধতিতে প্রসব হলে।
ভ্যাজাইনাতে কিছু ব্যাকটিরিয়া থাকে সেই ব্যাকটিরিয়ার মধ্যে দিয়ে প্রসবের সময় যখন শিশু বেরিয়ে আসে, ব্যাকটিরিয়ার সংস্পর্শে শিশুর ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব ভালো হয়। এই সন্তানরা অনেক বেশি সুস্থ থাকে।
ফোন - ৯৮৩০২৪১১১১