বিয়ে সমাজের এক পবিত্র ও আবহমান বন্ধন। এই সম্পর্ককে ঘিরে থাকে ভালোবাসা, বিশ্বাস আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন। কিন্তু সম্প্রতি চারপাশে ঘটে চলা কিছু ঘটনা আমাদের সেই চিরাচরিত ধারণা টলিয়ে দিয়েছে। যেমন সোনম-রাজার ঘটনা। মেঘালয়ে মধুচন্দ্রিমায় গিয়ে স্বামীকে খুনে অভিযুক্ত সোনম। আবার ঝাড়খণ্ডে বিয়ের ৩৬ দিনের মাথায় স্বামীকে বিষ খাইয়ে হত্যার অভিযোগ স্ত্রীর বিরুদ্ধে। এসবেরও আগে চাঞ্চল্য ছড়ায় মুসকানের 'কীর্তি'। স্বামীকে হত্যার অভিযোগে আপাতত যিনি জেলে। এই জটিল মানসিক প্রবণতার উৎপত্তি কোথায়, সমাধানই বা কী? উত্তর দিলেন 'ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়াট্রি- আ সেন্টার অফ এক্সেলেন্স'-এর অভিজ্ঞ চিকিৎসক ড. শ্রীতমা চট্টোপাধ্যায়।
প্রশ্ন: বলা হয়, বিয়ে সাতজন্মের বাঁধন। তাহলে বিয়ের পরই ছেড়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে কেন? কেন বিয়ের পর পার্টনারকে খুনের মনোবৃত্তি জন্মাচ্ছে?
উত্তর: বিবাহ আমাদের জীবনে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিশন। এটি কেবল দু'টি মানুষের মিলন নয়, দু'টি পরিবারের ইমোশনকেও কাছাকাছি নিয়ে আসে। কিন্তু এই পবিত্র বন্ধন সব সময় মসৃণ হয় না। অনেক সময় এই বদল স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে না পারার কারণে জন্ম নেয় জটিল মানসিক সংঘাত, যার ফল ভুগতে হয় সংশ্লিষ্ট সকলকে। বিশেষ করে, যখন পারিবারিক চাপ বা সামাজিক প্রত্যাশার কারণে কেউ বিয়ে করেন, তখন পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। এমন অবস্থায় ব্যক্তি নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চলতে বাধ্য হন, যা তাঁর মানসিক সুস্থতার উপর গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত থেকে জন্ম নিতে পারে তীব্র বিরক্তি, হতাশা ও ক্ষোভ যা শেষ পর্যন্ত সঙ্গীর প্রতি 'এক্সট্রিম রিঅ্যাকশন'-এর জন্ম দিতে পারে।
প্রশ্ন: বিয়ের পর জীবনে নানা ধরনের বদল আসে বলেই কি এমন প্রবণতা জন্মায়?
অনেকের মনে হয়, বিয়ের মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই স্বাধীনতাহীনতার অনুভূতি এতটাই প্রবল হতে পারে যে, তা ফিরে পাওয়ার জন্য ব্যক্তি যেকোনও চরম পদক্ষেপ করতে দ্বিধা করে না। যার ফলে তাদের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক হতে পারে।এছাড়াও, বিয়ের আগে যদি কোনও ছেলে বা মেয়ের জীবনে অতীতের কোনও গভীর মানসিক আঘাত বা ট্রমা থেকে থাকে, যা তারা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি, তাহলে বিবাহের চাপ সেই পুরনো ক্ষতগুলিকে নতুন করে জাগিয়ে তুলতে পারে। পরিবার থেকে চাপিয়ে দেওয়া বিবাহের ক্ষেত্রে এই ট্রমাগুলো আরও প্রকট হয়ে ওঠে। বাড়ির লোকের প্রতি জমে থাকা রাগ বা ক্ষোভ এই পরিস্থিতিতে ট্রিগার হিসেবে কাজ করে। এই সম্মিলিত মানসিক চাপ ব্যক্তিটিকে এমন এক অবস্থায় নিয়ে যায়, যেখানে নিজের 'ফ্রিডম' ফিরিয়ে আনার আকাঙ্ক্ষা এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে, তারা যেকোনও চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তার পরিণতি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করে না। তাদের কাছে তখন নিজেদের মুক্তিই একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, যার জন্য তারা যেকোনও মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকে।
প্রশ্ন: বিয়ের আগে পার্টনারকে কী কী প্রশ্ন করা উচিত যাতে বোঝা যায় সে সত্যিই বিয়ে করতে চায়?
উত্তর: অনেক সময়ই পারিবারিক বা সামাজিক চাপে বিবাহের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। সুস্থ সম্পর্কের ভিত্তি হল খোলামেলা এবং নির্ভার আলোচনা। বিয়ের আগে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা উচিত যেখানে কোনও external pressure ছাড়াই দু'জন মানুষ মুখোমুখি বসে নিজেদের মনের কথা বলতে পারে। সবার আগে জানা দরকার, পাত্র-পাত্রী দু'জনেই কি মানসিকভাবে বিবাহের জন্য প্রস্তুত? এই প্রস্তুতি কি নিজের ইচ্ছায় নাকি কেবল পরিবারের চাপেই? এই মৌলিক প্রশ্নের উত্তরটি স্পষ্ট হওয়া অত্যন্ত জরুরি। যদি উভয়েই বিয়েতে সম্মত হয়, তাহলে তাদের সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি (coping mechanism) বোঝা দরকার। অতীতে কোনও সম্পর্ক ছিল কিনা, বর্তমানে তাদের মানসিক অবস্থান কী, এবং তাদের নিজস্ব চাওয়া-পাওয়াগুলো (clarify intentions) কী- এইসব বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক। এই আলোচনায় কোনওরকম চাপ ছাড়াই তারা সত্যিটা বলতে পারছে কিনা তা খেয়াল রাখা উচিত। কারণ, এই স্বচ্ছতা একটি সুস্থ ও দীর্ঘস্থায়ী বৈবাহিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি।
প্রশ্ন: পার্টনারের কোন কোন আচরণ দেখলে সদ্য বিবাহিতদের সতর্ক হওয়া উচিত?
উত্তর: সঙ্গী নির্বাচনের পূর্বে তার স্ট্রেস হ্যান্ডেলিং ক্ষমতা খতিয়ে দেখা অপরিহার্য। কঠিন পরিস্থিতিতে সে কীভাবে শান্ত থাকে, প্রতিক্রিয়া জানায় ও সমাধান খোঁজে, তা ভবিষ্যৎ সম্পর্কের স্থিতিশীলতা নির্দেশ করে।
এছাড়াও, উভয়ের জীবনের লক্ষ্য কতটা সুসংহত, তা বোঝা দরকার। একা নয়, বরং একসঙ্গে পথ চলার এবং নিজেদের জীবনকে উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তাদের চিন্তাভাবনা কী তা আলোচনা করা উচিত। সম্পর্ক কতটা শান্তিপূর্ণ থাকবে এবং চরম প্রতিকূলতা তারা কীভাবে একসঙ্গে মোকাবিলা করবে, এই বিষয়গুলো স্পষ্ট থাকলে সঙ্গী নির্বাচনে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়।
প্রশ্ন: কোন মানসিকতা থেকে সোনম খুন করল? ও তো পালিয়ে যেতে পারত?
উত্তর: অনেক সময় ব্যক্তি এমন এক ফ্যান্টাসির জগতে বাস করে, যেখানে সে ভাবে সঙ্গীকে জীবন থেকে সরিয়ে দিলেই বুঝি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সোনমের ঘটনা তারই এক উদাহরণ হতে পারে।
প্রশ্ন: বিয়ের উপর থেকে মানুষের বিশ্বাস হারিয়ে যাচ্ছে, এটা কি ঠিক?
উত্তর: তরুণ প্রজন্ম যদি বিবাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তা কেবল সাম্প্রতিক ঘটনা থেকে পাওয়া ভয়কে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, অসংখ্য দম্পতি প্রতিকূলতায় একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে শক্তি ও সমর্থন জোগায়। সব সম্পর্কের পরিণতি সোনমের ঘটনার মতো হয় না। তাই কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা দেখে বিবাহের মতো একটি সুন্দর বন্ধনের উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা বা একে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করে দেওয়া কোনওভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়। বরং, সচেতন নির্বাচন ও মানসিক প্রস্তুতিই সুখী দাম্পত্যের চাবিকাঠি।
প্রশ্ন: বিশ্বাস ফেরাতে কী কী করণীয়?
উত্তর: বিবাহকে একটি এককালীন গন্তব্য (one-time destination) ভাবা ভুল। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, যেখানে প্রতিনিয়ত যত্ন ও এফর্ট প্রয়োজন। যেকোনও সম্পর্কের মতোই বিবাহের বন্ধনকেও লালন করতে হয়। যদি কেউ দাম্পত্যে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন বা হতাশ হন, তবে একজন বিশেষজ্ঞ মনোবিদের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।