জীবন রাখুন খোলামেলা, প্রাণবন্ত, মন থাকুক চনমনে। কারণ মস্তিষ্কের জন্য অতিরিক্ত চাপ পড়লে হতে পারে ব্রেন হেমারেজ (Brain Hemorrhage)। তাই মানসিক চাপ থেকে রক্তচাপ সবই রাখতে হবে স্বাভাবিক। আরও অনেক কারণ আছে। কেন বাড়ছে কম বয়সিদের মধ্যে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের প্রবণতা? বুঝিয়ে বললেন নিউরোলজিস্ট ডা. গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়।
আসলে কোনও কিছুই কার্যকর নয় যদি মন ভিতর থেকে শান্ত না থাকে। না হলে সম্প্রতি সদগুরুর মতো যোগী ব্যক্তি ব্রেন হেমারেজ বা মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের সমস্যায় আক্রান্ত হন! এত সংযমী যোগসাধকেরও যে এমন সমস্যা হতে পারে এটা ভাবাই যান না। বয়স একটা ফ্যাক্টর ঠিকই। কিন্তু তার পাশাপাশি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা ব্রেন হেমারেজের একটি অন্যতম কারণ হল মানসিক চাপও।
ছবি: সংগৃহীত
পড়াশোনা, কেরিয়ার, পারিপার্শ্বিক চাপ থেকে নানা দুশ্চিন্তা, সব কিছু সামলাতে গিয়েই বাড়ছে অল্প বয়সে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের প্রবণতা। দুদশক আগেও যেখানে মানুষ সুস্থ জীবন যাপনের মধ্যে বাঁচত, আজ সে সব কিছুই আর নেই। বয়স্কদের সঙ্গে সঙ্গে এখন মাত্র ২০-২৪ বছর বয়সি ছেলেমেয়েদের মধ্যেও বেড়েছে ব্রেন হেমারেজের ঘটনা। মানসিক চাপ একটি কারণ মাত্র, রয়েছে আরও অন্য কারণও। এমনকী, বিভিন্ন ওষুধের কোর্স শেষ না হলেও তা থেকেও হতে পারে মস্তিষ্কের মধ্যে রক্তক্ষরণ। তাই সাবধান। রোজকার জীবনযাপনে কোনও রকম ত্রুটিবিচ্যুতি কিন্তু ডেকে আনতে পারে এই জটিল অসুখ।
যে যে কারণে হয়
সাধারণত উচ্চরক্তচাপ থেকে এই ধরনের অসুখ দেখা দিতে পারে। এছাড়া আজকের দিনে ডায়াবেটিস, ওবেসিটিতে প্রায় অধিকাংশই আক্রান্ত, তার সঙ্গে ধূমপান, মদ্যপান, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা যুক্ত হয়ে মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণের ঘটনা ঘটায়। ব্রেন হেমারেজও কিন্তু এক ধরনের ব্রেন স্ট্রোক।
ঠিক কী হয়?
আসলে মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত অক্সিজেন প্রয়োজন ব্রেন ফাংশন ঠিক রাখার জন্য। যা রক্তনালির মাধ্যমে সরবরাহ হয়। যখন ব্রেনের মধ্যে রক্তনালি লিক করে বা ফেটে যায় তখন মস্কিষ্কের আচ্ছাদন অথবা মস্তিষ্ক ও খুলির মধ্যে যে স্থান থাকে সেখানে রক্ত জমে থাকে। যা ব্রেনে খুব চাপ তৈরি করে এবং অক্সিজেন পৌঁছতে বাধা দেয় ও স্নায়ুকোষের মধ্যে পর্যাপ্ত পুষ্টির জোগান বন্ধ করে। যা প্রাণঘাতী হয়ে পারে অথবা শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতা তৈরি করে।
ব্রেন হেমারেজের আরও কিছু কারণ হল, ধমনি বেলুনের ফুলে ওঠে (অ্যানিউরিজম) ও ফেটে যাওয়া, রক্তে প্লেটলেটের অভাব, ব্রেন টিউমার, সংক্রামক অসুখ, লিভার সিরোসিস ও কোনও আঘাতজনিত কারণ।
ছবি: সংগৃহীত
কী করে বুঝবেন?
ব্রেন হেমারেজ নির্ণয় করতে গেলে সিটি স্ক্যান বা এমআরআই করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
ব্রেন হেমারেজের লক্ষণ হল, হঠাৎ করে তীব্র মাথাব্যথা অথবা মাথার একদিকে ব্যথা শুরু হওয়া যা সাধারণ মাথাব্যথা থেকে আলাদা ধরনের হয়। মেনিনজিসের মধ্যে (মাথার আচ্ছাদন) রক্তক্ষরণ হলে সেটাকে সাবঅ্যারাকনয়েড হেমারেজ বলা হয়। সেক্ষেত্রে তীব্র মাথাব্যথা হল সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গ।
[আরও পড়ুন: চরম গরমে জেল্লা হারাচ্ছে ত্বক? ঘরোয়া উপায়েই দূর করুন সমস্যা, রইল টিপস]
এছাড়াও কিছু লক্ষণ রয়েছে, স্ট্রোক হলে তা প্রকাশ পায়। এগুলি দেখলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। যেমন-BEFAST
B (Balance) - হঠাৎ ভারসাম্য হারানো
E (Eye) - চোখ বা হঠাৎ চোখ ট্যারা হয়ে যাওয়া, একটা জিনিসকে দুটো দেখা, দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়া।
F (Face) - একদিকের মুখে বেঁকে যাওয়া
A (Arm) - হঠাৎ একদিকের হাত-পা পড়ে যাওয়া বা অসাড় হয়ে যাওয়া।
S (Speech) - কথার স্বর জড়িয়ে যাওয়া
T (Time)- সময়, এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ যত তাড়াতাড়ি আমরা রোগীকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া যাবে তত দ্রুত রোগ নির্ণয় হবে ও রোগী দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন।
হেমারেজিক স্ট্রোক না কি ইনচেমিক স্ট্রোক সেটা দ্রুত নির্ণয় করা খুব দরকার। তাহলে অনেকাংশে শারীরিক ও মানসিকভাবে রোগীকে সুস্থ জীবন ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। এছাড়া হঠাৎ প্রচণ্ড মাথাব্যথা, খিঁচুনি হওয়া, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, স্ট্রোকের উপসর্গের মধ্যে পড়তে পারে।
প্রথমেই কী করণীয়?
প্রাথমিক কোন লক্ষণ বুঝলে সবার প্রথম চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। তারপর সিটি স্ক্যান করে চিকিৎসার ধাপগুলি নির্ণয় করা হয়। চিকিৎসা শুরু হওয়ার আগে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে ধাপে ধাপে। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, কারও প্রেশার হাই থাকলে সেটা হঠাৎ নামানো যায় না। কমাতে হয় মস্তিষ্কের চাপ বা দুশ্চিন্তা। প্রয়োজনে হাইপার ভেন্টিলেশনের সাহায্য নেওয়া হয়। প্রেশারের সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল রাখতে হয় সুগারেরও, যাতে হঠাৎ করে কমে না যায় সেই দিকেও নজর রাখা হয়। সোডিয়াম, পটাশিয়ামের মাত্রা ঠিক রয়েছে কি না সেটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জ্বর হলে জ্বরের চিকিৎসাও করা দরকার। জ্বর না কমলে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের অনেক বেশি ক্ষতি হয়।
ছবি: সংগৃহীত
কিছু ব্যাপারে সাবধান
ধূমপান বর্জন, অ্যালকোহল বর্জন, ফাস্টফুড এড়িয়ে চলা উচিত। সব সময় চিন্তামুক্ত, সুস্থ জীবন যাপন, ওজন নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত শরীর চর্চা, ওষুধ খাওয়া, ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখা, প্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখা ও রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় অ্যাকসিডেন্ট যাতে না হয় সবরকম সাবধানতা নেওয়া জরুরি। মাথা যন্ত্রণা বা মাইগ্রেন থাকলে তা এড়িয়ে চললে হবে না। অবশ্যই নিতে হবে চিকিৎসকদের পরামর্শ। এর সঙ্গে সঙ্গে যদি বংশগত স্ট্রোকের ইতিহাস থাকে তাহলে তাঁকে আগে থেকেই হতে হবে সাবধান।
চিকিৎসা কী?
মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ মানেই সব শেষ নয়। অপারেশন ছাড়াও সারিয়ে তোলা সম্ভব। তার আগে বুঝতে হবে কোথায় রক্তক্ষরণ হচ্ছে! যদি নিচের দিকে রক্তক্ষরণ হয় তাহলে শুধুমাত্র অপরেশনের মাধ্যমে সারিয়ে তোলা যায়। অন্যদিকে, ব্রেনের খুব ভিতরের রক্তক্ষরণ হলে অপারেশনের ফলাফল খুব একটা ভালো লক্ষ করা যায় না। নেওয়া হয় অন্য পদ্ধতির সাহায্য। প্রয়োগ করা হয় বিশেষ ওষুধ। ব্রেন হেমারেজের চিকিৎসা পদ্ধতি হল, অপারেশন, অ্যানিউরজম ক্লিপিং অথবা কয়েলিং, ব্রেনের প্রেশার কমানো। সমস্যা অনুযায়ী চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নেন কোন পথে চিকিৎসা হবে। চিকিৎসার সঙ্গে ফিজিওথেরাপি করলে রোগী অনেক দ্রুত স্বাভাবিক হতে পারেন। রোগী সুস্থ হয়ে গেলে পরে সঠিকভাবে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন। যদিও, এটি নির্ভর করে কতটা পরিমাণে রক্তক্ষরণ হয়েছে তার উপর।