সমস্ত মৌমাছি কম বেশি পরাগ মিলনে সাহায্য করে। এর মধ্যে অন্যতম ভ্রমর। ভারতের কিছু কিছু রাজ্যে তাদের অধিক লক্ষ্য করা যায়। এরা যখন ফুলের উপর দিয়ে ওড়ে তখন ডানা দিয়ে ভোঁ ভোঁ শব্দ তৈরি করে। সেই শব্দের মাধ্যমে কম্পন সৃষ্টি করে ফুলের পরাগ মিলন ঘটায়। লিখেছেন বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের গবেষক শিবনাথ হাঁসদা ও কৌশিক প্রামাণিক। পড়ুন প্রথম পর্ব।
প্রাচীনকাল থেকে মৌমাছি মানুষের নিকট অতি পরিচিত এক প্রকার ক্ষুদ্র, উপকারী ও পরিশ্রমী পতঙ্গ। এরা সাধারণত দলবদ্ধভাবে বাস করে বলে এদের ‘সামাজিক পতঙ্গ’ বলা হয়। মৌমাছিরা ফুলের পরাগায়ণ ঘটিয়ে বনজ, ফলজ ও কৃষিজ ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। মেরুএলাকা ব্যতীত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আজ পর্যন্ত ১৯ টি গোত্রের অধীনে প্রায় ২০,৪০০ প্রজাতির মৌমাছি শনাক্ত করা হয়েছে। এদের শতকরা ৯৫ ভাগই একাকী, নিঃসঙ্গ জীবন কাটায়। অবশিষ্ট প্রজাতিগুলি সামাজিক, দলবদ্ধ বা কলোনিবদ্ধ হয়ে কাজের দায়দায়িত্ব ভাগবাটোয়ারা করে এক সঙ্গে বাস করে। মৌমাছিরা বন্য গাছপালা এবং ফসল উভয়েরই পরাগ মিলনে মুখ্য ভুমিকা পালন করে ও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইকোসিস্টেম তৈরি করে। ভারতে প্রায় ৭০০ বা তার বেশি মৌমাছির প্রজাতির মধ্যে পাঁচটিই সামাজিক মৌমাছি, যারা মৌচাকে বাস করে এবং মধু তৈরি করে; বাকিগুলি ‘সলিটারি’ মৌমাছি, যাদের কোনও সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস নেই ।
সলিটারি মৌমাছিদের বেশিরভাগ প্রজাতি বছরে মাত্র একবারই ডিম পাড়ে, কতকের আবার বছরে দুটি প্রজন্ম হয়। আজ পর্যন্ত জানা গিয়েছে প্রায় সব সলিটারি মৌমাছিরা একান্তবাসী এবং গ্রীষ্মমণ্ডল ও নাতিশীতোষ্ণমণ্ডলের অধিবাসী। এই সামস্ত মৌমাছি দেখতে সাধারণ মৌমাছিদের সঙ্গে কোনও সাদৃশ্য নেই। ‘সলিটারি’ মৌমাছিরা বিভিন্ন শস্য যেমন: শশা, টম্যাটো, বেগুন, শিম, লঙ্কা, অরহর এবং অন্যান্য ধরণের মুসুর জাতীয় শস্যের পরাগায়ণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অরহড়, সানহেম্প, লঙ্কা, ক্যাপসিকাম এবং টম্যাটো জাতীয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফসলের ফুলের পরাগধানীগুলো ফুলের অনেক ভিতরে এবং পাপড়িগুলো খুবই একবদ্ধভাবে থাকে, তাই সাধারণ মৌমাছিরা এদের পরাগায়ণ ঠিকমতো করতে পারে না। কিন্তু সলিটারি মৌমাছিরা তাদের ‘buzz pollination’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খুব সহজেই এসব ফসলের পরাগায়ণ করতে পারে।
[আরও পড়ুন: মাঠে নয়, ধান ফলছে ছাদে, অভিনব পদ্ধতি চাষ করে তাক লাগালেন দত্তপুকুরের বাসিন্দা]
ভারতে যেসব প্রজাতি রয়েছে তাদের বেশিরভাগ Xylocopa, Megachile, Nomada, Nomia, Andrena, Pithitis, Sphecodes, Lasioglossum, Ceratina এবং Halictus গণের সদস্য। সব প্রজাতিই অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং ফসলের পরাগযোগে ভূমিকা রাখে। বেশিরভাগ ‘সলিটারি’ মৌমাছির প্রজাতিগুলি মাটির নিচে একক বা জটিল বাসা বাঁধে, কিছু আবার ফাঁপা গাছে, গাছের ফোঁকরে, নরম কাঠ অথবা বাঁশের মধ্যে, নলখাগড়া এবং এ ধরনের গাছপালায় বাসা বাঁধে। তবে বাসা তৈরির ধরন ও উপকরণে সীমাহীন বৈচিত্র্য রয়েছে (যেমন -কাদা, বিভিন্ন ধরনের ফুলের পাঁপড়ি, পাতা, রেসিন, মাটির সূক্ষ্ম দানা, নুড়ি ইত্যাদি) ।
সমস্ত মৌমাছি কম বেশি পরাগ মিলনে সাহায্য করে। এর মধ্যে অন্যতম হল ভ্রমর।
ভারতের কিছু কিছু রাজ্যে এদের অধিকভাবে লক্ষ্য করা যায় যেমন- কেরল, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, এবং পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গে সাধারণত দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার ও উত্তর ২৪ পরগনায় এদের প্রাচুর্য দেখা যায়। এই মৌমাছিরা একাকী এবং নিজেরাই নিজেদের আত্মরক্ষা করে। যেহেতু এই মৌমাছিরা মধু তৈরি করে না তাই সাধারণ মৌমাছিদের মতো এরা অত আক্রমণাত্মক হয় না। সুতরাং এই মৌমাছিরা বাড়ির বাচ্চাদের এবং পোষ্য প্রাণীদের জন্য নিরাপদ এবং বাগানে এদের উপস্থিতি কোন আতঙ্ক বা ক্ষতির সৃষ্টি করে না।
চেনার উপায়
১) এই প্রজাতির সমস্ত মৌমাছিরা কালো রঙের হয়ে থাকে, অথবা পিঠের উপরে হলুদ, নীলাভ, সবুজাভ ইত্যাদি বর্ণ দেখতে পাওয়া যায়।
২) এদের শরীর মসৃণ এবং লোমবিহীন হয়।
৩) ডানায় নীল এবং কালো রঙের মিশ্রণ দেখতে পাওয়া যায় ।
৪) স্ত্রী মৌমাছিরা হুল বিশিষ্ট এবং পুরুষ মৌমাছিরা হুল বিহীন হয় ।৫) সাধারণত এদের আকার হয় ২০-২৫ মিমি অবধি।
বাসার ধরন
১) এই মৌমাছিরা সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করে না।
২) এদের স্ত্রী মৌমাছিরা নিজেরাই নিজের বাসা তৈরি করে সেখানে ডিম পাড়ে এবং ডিম পাড়ার আগে বাসায় বাচ্চার জন্য খাদ্যবস্তুর জোগান রাখে।
৩) এরা সাধারণত মৃত বাঁশ, পুরনো কাঠের লগ, বাড়ির জানালার ফ্রেম ইত্যাদি জায়গার মধ্যে বৃত্তকারে গর্ত করে।
৪) তাদের এই আচরণের জন্য ইংরেজিতে বলা হয় কারপেন্টার বি, উডবি, অথবা উড কাটার।
৫) সাধারণত গর্তের মুখের আয়তন ১/২ ইঞ্চি এবং গভীরতা ৬-১০ ইঞ্চি হয়ে থাকে।
৬) তবে অনেক প্রজাতিতে এর ব্যতিক্রম হয়, লক্ষ্য করা গিয়েছে কিছু প্রজাতি বাসা তৈরি করে দলবদ্ধ ভাবে থাকে এবং সেখানে শুধুমাত্র স্ত্রী মৌমাছিরাই বসবাস করে ।
৭) এরা বাসার মধ্যে ছোট ছোট ৮-১০ টা কোষ তৈরি করে, প্রতিটি কোশে একটি করে ডিম দেয় এবং বাচ্চার জন্য খাবার (পরাগরেণু) মজুত রাখে।
৮) এই মৌমাছিদের একটি বাসার মধ্যে একটি প্রজন্মই বাস করে।
ফুলের পরাগায়ণ পক্রিয়া
এই মৌমাছিদের পায়ে ফুলের রেণু সংগ্রহের জন্য শ্রমিক মৌমাছিদের মতো ‘pollen basket’ থাকে না। এরা যখন ফুলের উপর দিয়ে ওড়ে তখন ডানা দিয়ে ভোঁ ভোঁ শব্দ তৈরি করে এবং সেই শব্দের মাধ্যমে কম্পন সৃষ্টি করে পরাগ মিলন ঘটায়। গবেষণা করে জানা গেছে, সমস্ত প্রজাতির মৌমাছি থেকে এই প্রজাতির মৌমাছিরা একাকী ১৫ শতাংশ পর্যন্ত পরাগমিলন ঘটাতে সক্ষম।