ডোবা, খাল, বিল ইত্যাদি এবং পুরনো পুকুর-সহ বিভিন্ন জলাশয়ে আগে প্রচুর পরিমাণে শিঙিমাছ পাওয়া যেত। বর্তমানে এই মাছ যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের দেশে অসংখ্য জলাশয় রয়েছে। সেখানে শিঙিমাছ চাষ করা সম্ভব। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কার্প জাতীয় মাছের চেয়ে লাভজনকভাবে শিঙিমাছ চাষ করা যেতে পারে। লিখেছেন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের শস্য শ্যামলা কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের মৎস্য বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ ড. স্বাগত ঘোষ। পড়ুন শেষ পর্ব।
ডিম দেওয়া সম্পূর্ণ হলে ব্রিডিং হাপা-সহ ব্রুডার মাছ ট্যাঙ্ক থেকে সরিয়ে অন্য ট্যাঙ্কে ছাড়তে হবে।
- হ্যাচিং পুলে স্বাভাবিক উষ্ণতার জলের মৃদু প্রবাহ দিতে হবে।
- ২০-২৪ ঘণ্টার মধ্যে ডিম থেকে রেণুপোনা বেরিয়ে আসে।
রেণু পোনা প্রতিপালন
- ডিম ফুটে রেণু পোনা বের হওয়ার পর ডিমের খোসা সরিয়ে ফেলতে হবে।
- ডিম ফোটার ৩-৪ দিন পর রেণু পোনাকে ডিমের কুসুম, টিউবিফেক্স ওয়ার্ম অথবা আর্টিমিয়া খেতে দেওয়া হয় ।
আঙুল পোনা (ফিংগার লিং) উৎপাদন
- নার্সারি পুকুরের ৫-১০ দিন বয়সের ধানি পোনা মজুত করে এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে আঙুল পোনা পাওয়া যায়।
- নার্সারি পুকুর সঠিকভাবে প্রস্তুত করে ৫-১০ দিন বয়সের ধানী পোনা বিঘা প্রতি ৫০,০০০-৬০,০০০টি পর্যন্ত মজুত করা যেতে পারে।
- নার্সারি পুকুর ১ মিটার উঁচু জাল দিয়ে ঘিরে দিতে হবে, যাতে ক্ষতিকারক ব্যাং, সাপ, গোসাপ ইত্যাদি পুকুরে প্রবেশ করতে না পারে।
- প্রাথমিকভাবে প্রতিদিন মাছের দেহের ওজনের ৬-১০ ভাগ খাবার দিনে দুইবারে খাওয়াতে হবে।
- খাদ্য হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত চিংড়ি বা পাঙ্গাসের নার্সারি ফিড ব্যবহার করা যেতে পারে।
- পোনা ছাড়ার ৩০-৪৫ দিনের মধ্যে পোনার আকার গড়ে ৪-৫ সেমি হয়।
- পুকুর ছাড়াও স্টিলের ট্রে, সিমেন্টের ট্যাঙ্ক বা খাঁচার (কেজ্ কালচার) মধ্যেও আঙুল পোনা উৎপাদন করা যেতে পারে।
[আরও পড়ুন: ধান জমিতে জৈব সার হিসাবে অপরিহার্য অ্যাজোলা, জেনে নিন ভাসমান জলজ ফার্ন চাষের পদ্ধতি]
স্টিলের ট্রে, সিমেন্টের ট্যাঙ্ক কিংবা খাঁচায় (কেজ্ কালচার)
- প্রতি বর্গমিটারে ১০০-২০০টি ধানি পোনা মজুত করলে ৩০-৪০ দিন পর আঙুল পোনা পাওয়া যায়।
- এক্ষেত্রে খাদ্য হিসেবে নার্সারি ফিড বা জুপ্ল্যাঙ্কটন দেওয়া যেতে পারে।
চাষ পদ্ধতি
- শিঙি মাছ চাষের জন্য ১-১.৫ মিটার গভীরতা বিশিষ্ট পুকুর উপযুক্ত।
- পুকুরের পাড় মেরামত করে পুকুর থেকে রাক্ষুসে মাছ সরিয়ে ফেলতে হবে।
- পুকুর শুকিয়ে ফেলতে পারলে সবচেয়ে ভাল হয়।
- বিঘা প্রতি ৩০ কেজি চুন, ১০০ কেজি গোবর, ৩ কেজি ইউরিয়া, ৬ কেজি এসএসপি সার অথবা বিঘা প্রতি ১০০ কেজি মহুয়া খোল প্রয়োগ করে পুকুর তৈরি করতে হবে।
- সার প্রয়োগের ৫-৭ দিন পর জল সবুজ বা হালকা বাদামি হলে এবং মহুয়া খোল প্রয়োগের ২৫-৩০ দিন পরে পুকুরে বিঘা প্রতি ৩৫,০০০-৪০,০০০ টি পোনা ছাড়া যাবে।
- পুকুর ১মিটার উঁচু জাল দিয়ে ঘিরে দিতে হবে।
খাদ্য প্রয়োগ
- মাছের দেহের ওজনের ৪-৫ শতাংশ হারে দিনে ২ বার খাবার দিতে হবে।
- খাবারে প্রোটিনের পরিমাণ ৩০-৩৫ শতাংশ হলে ভালো হয়।
- খাবার হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত ক্যাটফিস ফিড নিম্নলিখিতভাবে ফর্মুলা অনুযায়ী তৈরি করে দেওয়া যেতে পারে।
রোগ নিয়ন্ত্রণ
- শিঙি মাছ একটু শক্ত প্রকৃতির মাছ হওয়ায় রোগব্যাধি খুব একটা দেখা যায় না।
- পোনা মজুত করার সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে পোনা আঘাতপ্রাপ্ত না হয়।
- পুকুরের জল নষ্ট হলে জল পরিবর্তন করতে হবে।
- জলের গুণাগুণ নষ্ট হলে মাছের ঘা দেখা দিতে পারে। এই রোগ নিয়ন্ত্রণে বিঘা প্রতি ৩০ কেজি চুন, ৫ কেজি লবণ, ১৫ দিন অন্তর প্রয়োগ করতে হবে।
- এছাড়াও প্রতিমাসে পুকুরে ১০ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করলে জলের গুণাগুণ ভাল থাকবে।
- কোনও কারণে জলের গুণাগুণ নষ্ট হলে বাইরে থেকে পরিষ্কার জল সরবরাহ করতে হবে।
মাছ আহরণ ও উৎপাদন
- জাল টানার পূর্বে জল কমিয়ে নিতে হবে।
- পুকুরে জাল টেনে বেশিরভাগ মাছ ধরে ফেলতে হবে।
- সম্পূর্ণ মাছ আহরণ করতে হলে পুকুর শুকিয়ে ফেলতে হবে।
- সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে ৬-৮ মাসে বিঘা প্রতি ১৫০০ কেজি পর্যন্ত উৎপাদন করতে পারে।
আয়ব্যয় পরামর্শ
- ব্রুড ও মজুতকৃত মাছকে নিয়মিত সুষম খাবার সরবরাহ করতে হবে।
- নার্সারি পুকুরে ধানি পোনা ছাড়ার পূর্বে ক্ষতিকারক হাঁস পোকা, ব্যাঙাচি, সাপ ইত্যাদি অপসারণ করতে হবে।
- নার্সারি পুকুরের পাড় দেড়ফুট উঁচু নাইলনের জাল দিয়ে ঘিরে দিতে হবে এবং জালের নিচের কিনারা
- মাটিতে গেঁথে দিতে হবে যাতে বর্ষার সময় মাছ না বের হতে পারে।
- চাষের পুকুরের পাড় জাল দিয়ে ঘিরে দিতে হবে, যাতে বর্ষার সময় মাছ উজান বেয়ে না বের হতে পারে।
- সুস্থ সবল পোনা পুকুরে ছাড়তে হবে।
- নিয়মিত জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
- জলের গুণাগুণের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।