পছন্দের যে কোনও জিনিস অনলাইনে কেনার ক্ষেত্রে আজ অনেকেরই অন্যতম পছন্দের মাধ্যম হল ইউপিআই। অর্থাৎ ইউনিফায়েড পেমেন্ট ইন্টারফেস। কিন্তু সাবধান! ফাঁদ পেতে রয়েছে সাইবার প্রতারকরা। বিপদ এড়াবেন কোন পথে, বাতলে দিলেন এইচডিএফসি ব্যাংকের ক্রেডিট ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড কন্ট্রোল-এর প্রধান মণীশ আগরওয়াল
সাম্প্রতিককালে, ইউনিফায়েড পেমেন্ট ইন্টারফেস (ইউপিআই) হয়ে উঠেছে সব রকম পেমেন্টে সবচেয়ে পছন্দের লেনদেনের ধরন। এক কাপ চা কেনা থেকে গৃহস্থালির সামগ্রী, সিনেমার টিকিট কেনা, শপিং, ডাইনিং বা ভ্রমণ যাই হোক না কেন! সবেতেই জরুরি ইউপিআই। বিমুদ্রাকরণের পর থেকে মানুষের লেনদেনের ধরন ক্রমশ বদলে গিয়েছে এবং এটি গতি অর্জন করেছে কোডিড-১৯ অতিমারি চলাকালীনই।
ইউপিআই-এর প্রসার কত বেড়েছে, তা এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়। মার্চ ২০২০-এ ইউপিআই মারফত লেনদেনন যেখানে ছিল ১২৫ কোটি, সেটাই বেড়ে মার্চ ২০২২-এ হয়েছে ৫৪০ কোটিতে। গত দু’বছরে, ইউপিআই বেড়েছে ৪ গুণ। মার্চ ২০২২-এ, ইউপিআই-এর অধীনে ‘প্রসেসড’ হওয়া মোট অঙ্ক ৯,৬০,৫৮২ কোটি টাকা।
[আরও পড়ুন: সাবধান থাকুন ভুইফোঁড় সংস্থা থেকে, বাজারে লগ্নি করতে ভরসা রাখুন বিশ্বস্ত নামে]
সরকার ও রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই) ধারাবাহিকভাবেই উৎসাহিত করে এসেছে একটি দেশীয় পেমেন্ট সিস্টেম তৈরি করতে, যা গ্রাহক-অভিজ্ঞতাকে আরও সমৃদ্ধ করবে এবং গ্রাহকদের সর্বোচ্চ স্তরের নিরাপত্তা প্রদান করার পাশাপাশি হাতে তুলে দেবে অত্যাধুনিক পণ্য। আরবিআই সম্প্রতি এটিএমগুলিতে ইউপিআই-এর মাধ্যমে কার্ডলেস ক্যাশ পরিষেবা ঘোষণা করেছে, যা ডিজিটাল ও কার্ডলেস ব্যাংকিং-এ নতুন দিগন্তের সৃষ্টি করবে। ক্যাশ ‘উইথড্র’ করার জন্য গ্রাহকদের আর কার্ড দরকার হবে না। শুধুমাত্র মোবাইল ফোনটিই যথেষ্ট।
ইউপিআই হল এমন একটি ‘রাউন্ড-দ্য-ক্লক’ পেমেন্ট সিস্টেম, যার সাহায্যে গ্রাহকরা টাকা পাঠাতে ও পেতে পারেন, এমনকী কিছু কিনতে পারেন, তা-ও আবার কারও কাছে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর প্রকাশ না করেই।
ইউপিআই আর্কিটেকচার হল SIM ও ‘ডিভাইস বাইন্ডিং’-এর উপর নির্ভরশীল। এটি লেনদেন সহজ করার পাশাপাশি নিরাপত্তাও প্রদান করে। সুরক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে ইউপিআই-ই হল সেরা যেখানে টাকার অপব্যবহার হয় না যদি না গ্রাহক তাতে জড়িত থাকে।
যদিও ডিজিটাল লেনদেন বেড়ে যাওয়ার ফলে সাইবার প্রতারকরা এই মাধ্যমটির প্রতি আকর্ষিত হচ্ছে বটে, কিন্তু ইউপিআই পরিষেবা যেহেতু অত্যন্ত সুচিন্তিত ও শক্তিশালী পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়-তাই প্রতারকদের পক্ষে বেশি দূর এগোনো অসম্ভব। কাজেই নিরুপায় হয়ে সাইবার অপরাধীরা নানা ধরনের ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ কৌশল প্রয়োগ করে প্রতারণার চেষ্টা করছে। গ্রাহকদের মন কাড়তে অবলম্বন করা হচ্ছে বিবিধ পন্থা। আকর্ষণীয় অফার, পুরস্কার, ক্যাশব্যাক, দুর্দান্ত চুক্তি, দারুণ পরিষেবার আশ্বাস দিয়ে লোভ দেখানো হচ্ছে।
কী কী ধরনের কৌশল প্রতারকরা ব্যবহার করতে পারে গ্রাহকদের ইউপিআই ব্যবহার থেকে দূরে রাখতে, তার তালিকা রইল নিচে :–
অনলাইন বাজারে প্রতারণা
প্রতারকরা নিজেদের পরিচয় দেয় খাঁটি ক্রেতা হিসাবে। তারপর পণ্যের বিক্রেতাকে টাকা দেওয়ার পরিবর্তে তারা ইউপিআই অ্যাপের মাধ্যমে ‘রিকোয়েস্ট মানি’ বিকল্প বেছে নেয়। এরা বিক্রেতার উপর জোরাজুরি করে তাকে সেই চয়েস ‘অ্যাপ্রুভ’ করতে বাধ্য করে, ইউপিআই পিন এন্টার করার মাধ্যমে। একবার বিক্রেতা পিন এন্টার করে দিলে টাকা সরাসরি প্রতারকের অ্যাকাউন্টে চলে যায়।
নকল হেল্পলাইন নম্বর
গ্রাহকরা তাঁদের ব্যাংক ও ইউটিলিটি সার্ভিস প্রভাইডারের কাস্টমার কেয়ার হেল্পলাইন নম্বর পেতে অনলাইনে নির্দিষ্ট সার্চ ইঞ্জিনে খোঁজ করেন। প্রতারকরা ওই সার্চ ইঞ্জিনে নকল কাস্টমার কেয়ার/হেল্পলাইন নম্বরের লিংক ডিসপ্লে করে। না জেনে, যখন কোনও গ্রাহক প্রতারককে ফোন করেন, প্রতারক গ্রাহকের ব্যাংক/সার্ভিস প্রভাইডারের প্রতিনিধি হওয়ার ভান করে। গ্রাহকের সমস্যা সমাধানের কথা বলে তাঁর মোবাইল/ল্যাপটপ/ডেস্কটপের অ্যাকসেস অর্জন করে নেয়। প্রতারকদের লোভনীয় অফারের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ে গ্রাহকরা নিজেদের ফোন থেকে পেমেন্ট করতে বাধ্য হন। আবার কখনও এমন কিছু স্ক্রিন শেয়ারিং অ্যাপ ডাউনলোড করেন, যার মাধ্যমে প্রতারকরা গ্রাহকের ডিভাইস অ্যাকসেস করতে পারে এবং তাঁদের গোপন ব্যাংকিং-এর খুঁটিনাটি চুরি করতে পারে।
সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে নকল অফার
সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে পণ্য পরিষেবার আকর্ষণীয় অফারের মাধ্যমেও অনেক সময় গ্রাহকদের ফাঁদে ফেলা হয়, যেমন :
• পেয়িং গেস্ট অ্যাকোমোডেশন
• গাড়ি কেনা-বেচা
• কম দামে ব্র্যান্ডেড ইলেকট্রনিক সামগ্রী
• গৃহস্থালি সামগ্রী
প্রতারকরা এসব ‘অভাবনীয় অফারের মাধ্যমে গ্রাহকের আস্থা একবার অর্জন করতে পারলেই কেল্লাফতে! তারা গ্রাহকের কাছে পেমেন্ট লিংক পাঠায়। যে মুহূর্তে গ্রাহক তাঁর PIN/OTP শেয়ার করেন, সঙ্গে সঙ্গেই গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট ডেবিট হয়ে যায়।
এই ধরনের ‘সাইবার অ্যাটাক’ থেকে গ্রাহকরা নিজেদের রক্ষা করতে পারেন নিচে বর্ণিত উপায় অবলম্বন করে :–
১. কোনও অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য আপনাকে থার্ড পার্টি অ্যাপ ডাউনলোড করতে বলছে, এমন কোনও কল এলে সতর্ক থাকুন।
২. কাস্টমার কেয়ার/হেল্পলাইন নম্বরের জন্য একমাত্র সংস্থার অফিসিয়াল ওয়েবসাইট দেখুন।
৩. এসএমএস বা হোয়াটসঅ্যাপে অজানা ব্যক্তি/সংস্থা দ্বারা পাঠানো লিংক কোনওমতেই ক্লিক করবেন না।
৪. আপনার ব্যক্তিগত ব্যাংক—তথ্য কখনও, কোনওভাবেই কাউকে শেয়ার করবেন না। যেমন ইউপিআই PIN, ডেবিটি/ক্রেডিট কার্ড নম্বর, সিভিভি, মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার তারিখ, ওটিপি, এটিএম PIN প্রভৃতি।
৫. মোবাইল আপনার পরিচয়। হঠাৎ যদি তা কাজ না করে, সঙ্গে সঙ্গে আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ‘নো ডেবিট’ রিকোয়েস্ট প্লেস করুন এবং আপনার টেলিকম সার্ভিস প্রোভাইডারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
৬. যে কোনও অস্বীকৃত লেনদেন হলে সঙ্গে সঙ্গে আপনার ব্যাংকে রিপোর্ট করুন এবং ন্যাশনাল সাইবার ক্রাইম হেল্পলাইন নম্বরে সবটা জানান ১৯৩০ নম্বরে কল করে।