ডা. অনির্বাণ দলুই: ‘ইট মোর। ইট লেস’। অর্থাৎ বেশিদিন ধরে খেতে চাইলে কম খাও। কিন্তু কে আর মনে রাখে এই সব প্রবাদ-প্রবচন! বর্তমানে খাদ্যাভাসে স্থূলতার শিকার দুনিয়ার প্রায় ৪৫ শতাংশ মানুষ। ক্যানসার বা করোনা নয়। বিশ্বের ধনীতম দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যকর্তাদের মাথাব্যথার কারণ এখন এই ওবেসিটি বা স্থূলতা। সে দেশের সার্জন জেনারেল দু’বছর আগে ওবেসিটিকে মহামারী ঘোষণা করেছেন।
একই মত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা‘হু’-রও। অর্থনীতিবিদ জন কেনেথ গলব্রেথের কথায়, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনাহারে যত লোকের মৃত্যু হয়, তার থেকে বেশি লোক মারা যান বেশি খেয়ে। এদেশের ছবিটাও খুব একটা আলাদা নয়। বর্তমানে ভারতে প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষই ওবেসিটির শিকার। মাঝবয়সিদের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে এই কারণেই। শিশুরাও বাদ নেই।”
ওবেসিটির নানা গ্রেড
আমাদের দেহে বডি মাস ইনডেক্স (BMI) দিয়ে ওবেসিটির পরিমাপ করা হয়। বিএমআই হল শরীরের উচ্চতা এবং ওজনের আনুপাতিক হার। একজন ব্যক্তির স্বাভাবিক বিএমআই এর সীমা হল ২০ থেকে ২৫-এর মধ্যে। কিন্তু বিএমআইয়ের মান ২৫ থেকে ৩০-এর মধ্যে হলে বলা হয় সেই ব্যক্তি স্থূল, ৩০-এর বেশি হলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ক্লাস-১ ওবেসিটি, ৩০-৩৫ হলে ক্লাস-২, ৩৫-৪০ হলে ক্লাস-৩ এবং ৪০-এর বেশি হলে সুপার ওবেসিটি।
অনেক রোগের কারণ
এখনকার অনেক অতি পরিচিত রোগের কারণ ওবেসিটি। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস মেলিটাস, অস্টিও আর্থ্রাইটিস, বন্ধ্যত্ব, নিদ্রাহীনতা, মানসিক অবসাদ, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি রোগ আজ ঘরে ঘরে। কেউ স্থূলতার শিকার হলে তার শরীরে ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। একে ‘মেটাবলিক সিনড্রোম’বলা হয়। এর জন্য কয়েক ধরনের ক্যানসারের আশঙ্কাও দেখা যায়। সমস্যা প্রায় পুরোটাই খাদ্যাভ্যাসের। ওবেসিটি নিয়ন্ত্রণে কোনও ওষুধ নেই। পর্যাপ্ত পরিশ্রম ও নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস থেকেই মুক্তি পাওয়া যাবে ওবেসিটি থেকে।
চিনি ও শর্করা বাদ
খাবার তালিকা থেকে চিনি বাদ রাখলে অনেকটাই ভাল থাকা সম্ভব। বিশেষত সাদা খাবার যেমন, কার্বোহাইড্রেট বা ময়দা, চিনি বাদ দেওয়া খুবই জরুরি। একবার এটা শুরু করলে ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ কমবে। শক্তি উৎপাদনের জন্য শরীর কার্বোহাইড্রেইট না পেলে শরীর চর্বি ভাঙতে শুরু করে ও ওজন কমে।
প্রোটিনযুক্ত খাবার খান
প্রতি খাবারে প্রোটিন, সবুজ সবজি ও চর্বি রাখুন। এই তিন ধরনের খাবার রাখা হলে এমনিতেই শর্করা গ্রহণের পরিমাণ কমে যাবে। প্রোটিনের উৎস- ডিম, মুরগি, মাছ, চিংড়ি ইত্যাদি খান। বেশি পরিমাণে প্রোটিন খাওয়া শুরু করলে বিপাকে পরিবর্তন দেখতে পাবেন। উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার ৬০ শতাংশ খিদে কমায়।
আলু কম
আলু খেলে ওজন বাড়ে এ আজ সবাই জানে। কারণ এতে থাকে শর্করা। তাই আলু বর্জন করুন। বদলে নির্দ্বিধায় খেতে পারেন ব্রকোলি, ফুলকপি, পালংশাক, বিন, ক্যাপসিকাম, বাঁধাকপি, মাশরুম, লেটুস, কপি, টমেটো ইত্যাদি।
কিছু খাবার যা ওজন কমায়
গ্রিন টি: গ্রিন টি তে থাকে বিশেষ ধরনের অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং ফ্যাট ভেঙে দেয়।
ফল: প্রতিদিন অন্তত একটা করে মরশুমি ফল খান। ডায়াবেটিস থাকলে কলা, আঙুর, আম পরিমিত খেতে পারেন।
মাছ: নিয়মিত মাছ খেলে ওজন তো কমবেই, সঙ্গে হার্ট এবং ব্রেনের ক্ষমতাও বাড়বে। কারণ, মাছে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, প্রোটিন, বিভিন্ন ভিটামিন এবং মিনারেল। তবে বড় পাকা মাছ খাবেন না।
ডাল: ওজন কমাতে গেলে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খেতেই হবে। ডিমে প্রোটিন রয়েছে, যা বহুক্ষণ পেট ভরিয়ে রাখে। ফলে বারে বারে খেতে ইচ্ছে করে না। তাই শরীরে অতিরিক্ত ক্যালরির প্রবেশ বন্ধ হয়। এক রিপোর্ট অনুসারে দিনে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরিমাণ মাত্র ২৫ শতাংশ বাড়ালেই বারে বারে খিদে পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৬০ শতাংশ কমে যায়।
টক দই: হজম ক্ষমতা বাড়লেও কিন্তু ওজন কমে। টক দইয়ে উপস্থিত উপকারী ব্যাকটিরিয়াগুলি হজম ক্ষমতাকে অনেকটাই বাড়িয়ে দেয়। সেই সঙ্গে প্রদাহের মাত্রাও কমে। ফলে মেদ ঝরে।
এছাড়াও অ্যাপেল সিডার ভিনিগার, অ্যাভোকাডো, বাদাম, আপেল, ভুট্টা, লেবু জাতীয় ফল, ওটস, অলিভ অয়েল ও জাম মেদ কমাতে সাহায্য করে।
[আরও পড়ুন: সকালে উঠে খালি পেটে চা খাচ্ছেন! ঠিক করছেন তো?]
ওজন কমাতে এড়িয়ে চলুন
- প্রাতরাশে ফাইবার রাখুন। কর্নফ্লেক্স বা হুইট ফ্লেক্সের পরিবর্তে মুসলি ভাল।
- চিনি ও দুধ ছাড়া চা বা কফি পান করুন কিন্তু সঙ্গে বিস্কুট ও কুকিজ নয়। পাফস, রাস্ক, ব্রেডস্টিকস, ক্র্যাকারস, ব্রাউনিজ, মাফিনস ইত্যাদি থেকে একেবারে দূরে থাকুন।
- শিঙাড়া, পকোড়া, লুচি বা তেলেভাজা না খাওয়াই ভাল। বিভিন্ন ধরনের ডেয়ারি প্রোডাক্ট, চকোলেট, আইসক্রিম, বার্গার, পিৎজার মতো খাবার বর্জন করাই বাঞ্ছনীয়।
- মিষ্টি বা ডেজার্ট একেবারেই খাবেন না। বেশিরভাগ মিষ্টিতে থাকে ট্রান্স ফ্যাট।
গোটা ফল খান কিন্তু ফলের রস নয়। গোটা ফলে ভিটামিন, মিনারেলস, ফাইবার ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকে কিন্তু ফলের রস খেলে তা দ্রুত হজম হয়, তাই বারবার
খিদে পায়। - অ্যালকোহল বর্জন করুন। এরিটেড পানীয়তে ১০০ মিলিতে প্রায় ১০-১২ গ্রাম সুগার থাকে। ওজনও বাড়ে।
- সারাদিন দুটো মেজর মিল অর্থাৎ দু’বার ভাল করে খান কিন্তু কম তেলে রান্না করুন।
অনেকেই মনে করেন, না খেয়ে থাকলেই বুঝি ওজন কমে। ধারণাটি একেবারেই ভুল। কারণ, শরীর দীর্ঘক্ষণ খাবার না পেলে এমার্জেন্সি মোডে চলে যায়। ফলে খাবার পেলেই তাকে ফ্যাটে পরিবর্তন করে শক্তি সঞ্চয় করে। তাই অতিরিক্ত ওজন কমাতে না খেয়ে থাকা কাজের কথা নয়।
অধ্যাপক ডা. অনির্বাণ দলুই
বারাসত গভর্নমেন্ট মেডিক্যাল কলেজের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।