নির্মল ধর: মানুষ হিংস্র বাঘ মারলে পুরস্কার মাত্র কয়েক হাজার টাকা। আর বাঘ লোকালয়ে ঢুকে মানুষ তুলে নিয়ে গেলে তার জন্য সরকারি বরাদ্দ আট লক্ষ টাকা। সরকারি এমন অদ্ভুত আদেশকে নিয়েই ক’বছর আগে উত্তরপ্রদেশের পিলভিটের জঙ্গলে বিশাল এক আর্থিক দুর্নীতির মস্ত ঘাঁটি তৈরি করেছিলেন পিলকুঞ্জ গ্রামের মুখিয়া রামেশ্বর গায়েন। সে নাকি এক সময় খালি হাতে বাঘ মেরেছিল! তাই গ্রামে তাঁর দারুণ একাধিপত্য, সরকারি আমলারাও তার দুর্নীতির শরিক, ভাগিদার। রামেশ্বরই ওই গ্রামের শেষ কথা। এই সত্যি কাহিনি নিয়েই বাংলা সিনেমার দুর্দান্ত প্রকৌশলী রিংগো অর্থাৎ অর্ণব রিংগো বানিয়েছেন তাঁর তিন নম্বর OTT সিরিজ ‘পিলকুঞ্জ’ (Pilkunj)। আনন্দের কথা এমন একটি প্রথা বিরোধী সিরিজ বানাতে রিংগোর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে ক্লিক।
এখনকার রাজনীতির সমীকরণে স্বাভাবিক কারণেই যোগী সরকারের পিলিভিট লোকেশনে কাজ করার অনুমতি পাননি রিংগো। তাঁকে চলে আসতে হয়েছে প্রতিবেশি রাজ্য ঝাড়খণ্ডে। না, সেজন্য তাঁকে খুব একটা সমঝোতায় হাঁটতে হয়নি, সেটা সিরিজ দেখেই বোঝা গেল। নদী, পাহাড়, জঙ্গল একইসঙ্গে পেয়ে গিয়েছেন রাঁচি, হাজারিবাগ, দুমকা অঞ্চল ঘিরে। রিংগো আড়াই ঘণ্টায় ছয় পর্বে সাজিয়েছেন চিত্রনাট্য। ‘পিলকুঞ্জ’-এ গ্রামের পরিবেশে বাঘ-কুমীর ভরা নদীর সঙ্গে সুন্দর পাখপাখালির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও ধরা পড়েছে তাঁর মোবাইল ক্যামেরায়। হ্যাঁ, তিনি পুরো ছবিটাই তুলেছেন নিজের মোবাইলে। অবশ্য সম্পাদনা ও গ্রেডিংয়ের কাজ তিনি নিজের স্টুডিওয় নিজের হাতেই করেছেন।
[আরও পড়ুন: চুপি চুপি আদিত্যকে নিয়ে গোয়ায় ছুটলেন অনন্যা পাণ্ডে! ক্যামেরা দেখেই মুখ লুকোলেন কেন জুটি?]
রামেশ্বর গায়েনের বাঘে-মানুষ মারার নিত্যনতুন সাজানো নাটকের খবর দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছে গেলে শুরু হয় তদন্ত। রিংগো অনেকটাই থ্রিলার ও রহস্যধর্মী ধারায় চিত্রনাট্য লিখেছেন। সেখানে রয়েছে রামেশ্বরের ছেলে শৈলেশের (জয়ী দেবরায়) মেয়েছেলের প্রতি লালসা, স্ত্রী ঝর্ণার (বৃষ্টি) সঙ্গে শারীরিক ঘনিষ্ঠতার কিছু মসলা মাখানো দৃশ্য, তাঁর সাগরেদ দল গুল্লা-বুল্টির (সোহম-দেবতনু) বখাটেপনা, তাদের আধুনিক ভাষার গালমন্দ-এখনকার বাংলা OTT সিরিজের যেগুলো বক্স অফিস ফর্মুলা, তারও কোনও ঘাটতি রাখেননি রিংগো। এবং অবশ্যই রাখা হয়েছে তরুণী ডাক্তার বিদিতা (তৃণা) ও কলকাতা থেকে যাওয়া এক আলোকচিত্রী সিদ্ধার্থকে (শন)। তাঁরা এই ছবির রোম্যান্টিক অ্যাঙ্গেলটি সামলেছেন। এবং স্ক্যান ও রহস্য উন্মোচনে তাঁদের কার্যকরী ভূমিকা তো থাকতেই বা রাখতেই হয়েছে।
রিংগোর সিরিজ তৈরির ঘরানার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা বঞ্চিত হবেন না ‘পিলকুঞ্জ’-এ তাঁর সিগনেচার টিউন থেকে। চিত্রগ্রহণের কারুকার্যের সঙ্গে বাঘ ও কুমীরের বেশ কিছু শটের কম্পিউটার গ্রাফিক্সের কাজ নিপুণ কন্টিনিউটির সঙ্গে বেশ জমজমাট করেও তুলেছেন। আর অভিনয়! নিশ্চিতভাবে সবার আগে নজর কাড়েন রামেশ্বর চরিত্রে বাংলা নাটকের পরিচিত মুখ শংকর নাথ। তাঁর বাচিক, শারীরিক অভিনয় এবং চোখ দুর্দান্ত লেগেছে। শৈলেশ ও তাঁর সাগরেদ – চরিত্রে জয়ী, সোহম, দেবতনু যেন থ্রি মাস্কেটিয়ার্স। তাঁদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এবং সংলাপ ডেলিভারি চোখে ও কানে লেগে থাকে। বিদিতা ও সিদ্ধার্থর ভূমিকায় তৃণা সাহা ও শন বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু চিত্রনাট্যের পাতার বাইরে তেমনভাবে আসতে না পারলেও তাঁদের আন্তরিক চেষ্টাকে কুর্নিশ জানাতেই হবে। দু’জনেরই আরও অনুশীলন জরুরি। জ্ঞান নয়, এটা পরামর্শ। তবে রিংগোর সিরিজে বেশিরভাগ সময়েই তিনি নিজেই থাকেন মাথা উঁচিয়ে! এখানেও তাই।
ওয়েব সিরিজ – পিলকুঞ্জ
অভিনয়ে – শংকর দেবনাথ, শন বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃণা সাহা, জয়ী দেবরায়, বৃষ্টি রায়, দেবতনু দাস প্রমুখ
পরিচালনা – রিংগো