shono
Advertisement

তারার খোঁজে তারাদের দেশেই বিলীন! মহাকাশেই মৃত্যু কল্পনা চাওলার, কী ঘটেছিল সেদিন?

কেন আর ফেরা হল না সাত মহাকাশচারীর?
Posted: 08:39 PM Dec 02, 2023Updated: 08:39 PM Dec 02, 2023

বিশ্বদীপ দে: ২০০৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। গোটা বিশ্বই অপেক্ষা করছিল ‘কলম্বিয়া’র জন্য। ১৫ দিনের মহাকাশ সফরশেষে ফিরবে নাসার মহাকাশযান। যে যানে রয়েছেন সাতজন মহাকাশচারী। তাঁদের অন্যতম কল্পনা চাওলা। ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন সেই নভোচারীর জন্ম হয়েছিল হরিয়ানায়। তাই ভারতীয়দের আলাদা কৌতূহল ছিল বছর চল্লিশের কল্পনাকে নিয়ে। কিন্তু উচ্ছ্বাস আচমকাই বদলে যায় বিষণ্ণতায়। মহাকাশযানটি আছড়ে পড়ার খবরে এদেশেও নেমে আসে শোকের ছায়া। কুড়ি বছর পেরিয়ে গিয়েছে। দুই দশকে পৃথিবী বদলে গিয়েছে অনেক। মহাকাশ অভিযানে ইসরো শুরু করেছে স্বপ্নের দৌড়। কিন্তু আজও কল্পনা রয়ে গিয়েছেন চর্চায়। তাঁর আশ্চর্য মৃত্যুর বিষাদগাথা বার বার প্রশ্ন তুলেছে, ঠিক কী হয়েছিল সেদিন? কেন আর ফেরা হল না কল্পনাদের?

Advertisement

সেই কথায় আসার আগে একবার কল্পনার (Kalpana Chawla) জীবনটা ফিরে দেখা দরকার। ১৯৬২ সালের ১৭ মার্চ হরিয়ানার কারনালে জন্ম তাঁর। সেখানেই স্কুলের পড়াশোনা। পরে পাঞ্জাবের কলেজ থেকে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি। এর পরই পাড়ি মার্কিন মুলুকে। সেখানে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার ডিগ্রি অর্জন। পরে কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডক্টরেট। ১৯৮৮ সালে নাসায় যোগদান। ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে মহাকাশচারী হিসেবে নির্বাচিত হওয়া। আর ১৯৯৭ সালে প্রথমবারের জন্য মহাকাশে পাড়ি দেওয়া! এককথায় বলতে গেলে, স্বপ্নের কেরিয়ার! কে ভেবেছিল এমন উড়ান মাত্র ছবছরেই শেষ হয়ে যাবে?

[আরও পড়ুন: শৌচাগারে রাখা মিড ডে মিলের চাল! চুরির অভিযোগে স্কুলে ‘তালাবন্দি’ দুই শিক্ষক]

আদ্যন্ত নিরামিষভোজী মধ্যবিত্ত এক হিন্দু পরিবারে জন্ম। বাবা টায়ার কারখানার মালিক। স্বভাবে ‘টমবয়’ কল্পনা কিন্তু ছোটবেলা থেকেই ছিলেন দুরন্ত। ক্রিকেট, কারাটে সবেতেই সমান উৎসাহ। পাশাপাশি পড়াশোনাতেও ছিলেন ক্লাসের প্রথম তিনজনের একজন। কিন্তু এই খেলা, পড়াশোনার পাশাপাশি আরও একটা ভালো লাগা ছিল কল্পনার। আকাশ। এরোপ্লেন থেকে নক্ষত্র, কালো আকাশে ভেসে থাকা সব কিছুই রোমাঞ্চিত করত তাঁকে। মনে মনে স্বপ্ন দেখতেন একদিন আকাশে ভাসবেন! পরবর্তী সময়ে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, ”আপনি নক্ষত্র ও ব্রহ্মাণ্ডের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন আপনি কোনও নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মানুষ নন। আপনি সৌরজগতের।”

২০০৩ সালের সেই অভিশপ্ত সফরের আগে একবারই মহাকাশে গিয়েছেন কল্পনা। ১৯৯৭ সালে এসটিএস-৮৭ মিশনের অংশ হিসেবে। সেবার ৩৭৬ ঘণ্টা ৩৪ মিনিট সাকুল্যে মহাশূন্যে ছিলেন তিনি। ভ্রমণ করেছিলেন ৬৫ লক্ষ মাইল। ২০০০ সালে কল্পনার দ্বিতীয় মহাকাশ অভিযান হওয়ার কথা ছিল। এসটিএস-১০৭-এর অংশ ছিলেন তিনি। কিন্তু নানা বাধায় সেই অভিযান পিছিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তা শুরু হয় ২০০৩ সালে। আর সেই অভিযানই হয়ে ওঠে কল্পনার শেষ অভিযান। কিন্তু মিশন সফল হয়েছিল। ছয় সঙ্গীকে নিয়ে ৩৭২ ঘণ্টা মহাকাশে ছিলেন কল্পনা। এর পর ফেরা। আর সেই ফেরাই রচনা করল এক ভয়ংকর শেষ দৃশ্য!

[আরও পড়ুন: ‘দোহাই জুড়ে দিন’, কল্যাণীর বিজেপি কর্মীর কাটা আঙুল আঁচলে জড়িয়ে হাসপাতালে দৌড় মায়ের]

আবার ফেরা যাক ২০০৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারিতে। কেনেডি স্পেস সেন্টারে সকলেই অপেক্ষা করছেন। কলম্বিয়া মিশনশেষে ভালোয় ভালোয় ফিরে আসুক। নাসার এন্ট্রি ফ্লাইট ডিরেক্টর লিরয় কেইন সবুজ সংকেত দিলেন শাটল কমান্ডার রিক হাজব্যান্ডকে। অর্থাৎ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সম্মতি। তিনি ও কল্পনা ছাড়াও মহাকাশযানে ছিলেন পাইলট উইলিয়াম ম্যাককুল, পে লোড কম্যান্ডার মিশেল অ্যান্ডারসন, আয়ান রামান, লরেল ক্লার্ক ও ডেভিড ব্রাউন। সকলের ফেরার অপেক্ষায় অধীর ছিলেন নাসার বিজ্ঞানী ও কর্মীরা। কিন্তু আচমকাই শিউরে উঠলেন স্পেস সেন্টারে হাজির দর্শকরা! আকাশে যে ভয়ংকর আগুনে শিখার ঝলকানি! সমস্ত আশঙ্কা সত্যি করে কলম্বিয়া ছত্রকায় হয়ে ছড়িয়ে পড়ল! আর সেই যানের সাত যাত্রীও মহাকাশযানের সঙ্গেই চিরকালের জন্য অন্তর্হিত হয়ে গেলেন সেখানে, যেখান থেকে কেউ কখনও ফিরতে পারে না।

ঠিক কী হয়েছিল? সমস্ত হাইড্রলিক সিস্টেম ঠিকঠাক থাকলেও হাইড্রলিক তরলের তাপমাত্রা আচমকাই কমতে শুরু করেছিল। আসলে হাইড্রলিক ট্যাঙ্কে লিক হওয়াতেই এই বিপত্তি হয়েছিল। রেডিও সিগন্যালও কাজ করছিল না। সেন্সরও একে একে শব্দের চেয়ে ১৮ গুণ দ্রুতগতিতে ছুটতে থাকা যানটি শেষ পর্যন্ত যান্ত্রিক ত্রুটিতেই ভেঙে পড়ে। তার আগেই হারিয়ে গিয়েছিল সমস্ত যোগাযোগ। শেষবার ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া গিয়েছিল ফ্লাইট ডিরেক্টরের। তার পর আর কিছুই শোনা যায়নি। মহাকাশবিজ্ঞানের অগ্রগতির পথে কল্পনাদের মৃত্যুকে শহিদের মৃত্যু বলেই মনে করা হয়।

কল্পনাকে আজও ভোলেনি মানুষ। জীবনরসে মজে থাকা মানুষটি একবার বলেছিলেন, তিনি মহাকাশকে এত ভালোবাসেন, একদিন এই মহাকাশই তাঁকে ছিনিয়ে নেবে। কী আশ্চর্য সমাপতন! শেষপর্যন্ত সেটাই সত্যি হয়েছিল। চিরকালের জন্য মহাশূন্যের সঙ্গেই মিশে গিয়েছে তাঁর নাম। দুই দশক পেরিয়ে এসেও বারে বারে ফিরে আসেন তিনি। যখনই মহাকাশে মানুষের সাফল্যের কথা নিয়ে আলোচনা হয়, এক ভারতীয় কন্যার অফুরান প্রাণশক্তি, ধীশক্তি এবং তাঁর আকাশজয়ের স্বপ্নের কথা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে চলে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement