shono
Advertisement

Breaking News

সত্যি বলে ‘সত্যি’ কিছু নেই

কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নিয়ে রাজনীতি তুঙ্গে।
Posted: 02:00 PM Mar 30, 2022Updated: 03:56 PM Mar 30, 2022

কাশ্মীরের ‘সত্য’ কী কী, সে ফিরিস্তি মহাভারত-সমান। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের দুর্দশা তার একটি অধ্যায় মাত্র। সেই দুর্দশার জন্য কারা দায়ী, কীভাবে দায়ী, কোন রাজনীতির কবলে উপত্যকার অ-মুসলিম জনতা তিন দশক ঠাঁইনাড়া, সেসব ‘পূর্ণ সত্য’ ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমায় প্রকাশিত ও প্রদর্শিত নয়। কিঞ্চিদধিক দু’-ঘণ্টার এই উপাখ্যান রচনার উদ্দেশ্য উগ্র-হিন্দুত্ববাদের পালে বাতাস জোগানো। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement

 

রবিন্দ কেজরিওয়ালের উপর খুব খেপেছে বিজেপি (BJP)। দলের বড়-মেজ-সেজ কর্তারা লাইন দিয়ে তাঁকে গালমন্দের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। সর্বশেষ সংযোজন হিমন্ত বিশ্বশর্মা। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে তিনি ঘোরতর ‘হিন্দু বিরোধী’ বলে দেগে দিয়েছেন। রাগের কারণ, ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ চলচ্চিত্রটির কর মকুবে কেজরিওয়াল রাজি হননি। ট্যাক্স-ফ্রি করার সমস্বর ঘ্যানঘেনে দাবি উপেক্ষা করে চুপ থাকলে না হয় একটা কথা ছিল, কিন্তু কেজরিওয়াল এমন সব খোঁচা মেরেছেন যাতে তাঁরা চিড়বিড়িয়ে উঠেছেন। তাই এত ক্রোধান্বিত বাক্য-বর্ষণ।

কেজরিওয়ালের বাচনভঙ্গি বেশ অভিনব। রাগেন না। উচ্চৈঃস্বরে শরনিক্ষেপও করেন না। ঠোঁটের কোনায় শ্লেষাত্মক একটা হাসি ঝুলিয়ে প্রতিপক্ষকে বিদ্রুপাত্মক হুল ফোটানোয় ওস্তাদ। বিধানসভায় যেমন বললেন, আরে বাবা, ট্যাক্স-ফ্রি করলে বেশি মানুষ সিনেমাটা দেখতে পাবে তাই তো? তা বাপু ইউটিউবে আপলোড করে দিলেই তো হয়! দূরদর্শনে দেখাও! সবাই বিনা পয়সায় দেখবে। এরপর বিজেপি সদস্যদের তাঁর কটাক্ষ, একটা লোক কাশ্মীরি পণ্ডিতদের (Kashmiri Pandit) দুর্দশা দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছে, আর আপনারা সেই ‘মিথ্যে’ ছবির পোস্টার সাঁটছেন! ‘মিথ্যে’ শব্দটা ছিল অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মোক্ষম হুল। কেননা, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এই সিনেমাকে ‘সত্য’ বলে সার্টিফিকেট দিয়েছেন।

[আরও পড়ুন: ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’: ক্ষমতা বদলায়, তবুও ফাইল চাপা আগুন নিভল কই?]

কাশ্মীরের ‘সত্য’ কী কী, সে ফিরিস্তি মহাভারত-সমান। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের দুর্দশা তার একটি অধ্যায় মাত্র। সেই দুর্দশার জন্য কারা দায়ী, কীভাবে দায়ী, কোন রাজনীতির বোড়ে হয়ে উপত্যকার অ-মুসলিম জনতা তিন দশক ঠাঁইনাড়া, সেসব ‘পূর্ণ সত্য’ এই সিনেমায় প্রকাশিত ও প্রদর্শিত নয়। কিঞ্চিদধিক দু’-ঘণ্টার এই উপাখ্যান রচনার উদ্দেশ্য উগ্র-হিন্দুত্ববাদের পালে বাতাস জোগানো। নির্মাতার সেই লক্ষ্য আঠারো আনা সফল। তর্কাতীতভাবে ‘সত্য’ এটাই। নইলে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে কর মকুবের এমন ধুম দেখা যেত না।

লক্ষ্মীর কৃপাধন্য হওয়ার পাশাপাশি পরিচালক নিজেকে শাসকপ্রিয়ও করে তুলেছেন। তাঁকে মাথায় তুলে নাচানাচি তারই প্রমাণ। শিল্পভিত্তিক রাজনীতি সময়ে সময়ে যেমন সূক্ষ্ম হয়, অনেক সময় তেমন স্থূলও হয়ে ওঠে। কেজরিওয়াল এই স্থূলতাকেই আক্রমণ করে বলেছেন, বিজেপির কাছে সিনেমাটা গুরুত্বপূর্ণ, কাশ্মীরি পণ্ডিতরা নন। পণ্ডিতরা প্রাধান্য পেলে আজও তাঁদের পরবাসী থাকতে হত না। কিন্তু তাঁর কাছে পণ্ডিতদের গুরুত্ব বেশি। ‘বেশি’ বলেই২৩৩ জন অস্থায়ী কাশ্মীরি পণ্ডিত স্কুলশিক্ষকের চাকরি তাঁর সরকার স্থায়ী করেছে, এতগুলো বছর যাঁদের কান্নায় ক্ষমতাসীনদের মন ভেজেনি।

কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নিয়ে রাজনীতি করেনি এমন দলের অস্তিত্ব দূরবিনেও ঠাহর হবে না। কেজরিওয়ালও রাজনীতি করছেন। তাঁর এতটা আক্রমণাত্মক হওয়ার কারণও রয়েছে। এই এপ্রিলে দিল্লির তিন পুরসভার ভোট হওয়ার কথা ছিল। সেটা আটকে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার তিন পুরসভার একীকরণে সংসদে বিল এনেছে। নতুন আইনে দিল্লিতে থাকবে একটিই পুরসভা, ২০১১ পর্যন্ত যেমন ছিল। মেয়র হবেন একজনই। ওয়ার্ড সংখ্যা ২৭০ থেকে কমে হবে ২৫০। ‘ডিলিমিটেশন’-এ সময় লাগবে বছরখানেক। অর্থাৎ, ভোট এখন বিশ বাও জলে। পাঞ্জাব জয়ের পর কেজরিওয়াল দিল্লি পুরসভা দখলে ছটফট করছিলেন। এখন অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই। বিজেপি বাড়া ভাতে ছাই ফেললে গোসা হওয়ারই কথা। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, পুরসভার এই ‘পুনর্মূষিক ভব’ কাহিনির বাড়তি টুইস্ট পুরসভার অধিকার রাজ্যের হাত থেকে পুরোপুরি কেন্দ্রের হাতে চলে যাওয়া। বিজেপি দিল্লির উপ-রাজ্যপালকে নির্বাচিত সরকারের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান করেছে। তাঁর ‘ভিটো’-ই শেষ কথা। এবার নেবে পুরসভার রাশ। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে আশ্রয় নিতে হবে কেন্দ্রীয় শাসকের ঘেরাটোপে। ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ নিয়ে কেজরিওয়াল এমনি-এমনি ট্যারাবাঁকা কথায় বিজেপিকে বিঁধছেন না।

পেশাগত কারণে কিঞ্চিৎ জ্ঞানার্জনের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, কাশ্মীরের ক্রমাবনতির দায় কেউ ঝেড়ে ফেলতে পারবে না। একদিকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় চক্রান্ত, অন্যদিকে কেন্দ্র-রাজ্যের ক্ষমতাসীনদের অনুসৃত নীতি, আমলাশাহি, সেনা ও আধা-সামরিক বাহিনী কিংবা পুলিশ-গোয়েন্দা প্রত্যেকে নিজের মতো করে ‘কাশ্মীর’ নামক গিনিপিগকে হিংস্র ডাইনোসরে পরিণত করেছে। যে-রাজ্য আটের দশকের শেষার্ধ পর্যন্ত আক্ষরিক অর্থেই ভূস্বর্গ ছিল; যেখানকার মানুষজন ছিল শান্তিপ্রিয়, ঘরকুনো, অলস ও আয়েশি; খুন-খারাপির ধারকাছ দিয়েও যাদের চলাফেরা ছিল না; রাতারাতি কীভাবে তারা রক্তের হোলিতে মত্ত হয়ে ওঠে সে এক অপার বিস্ময়! সেই বিস্ময়ের পরতে পরতে রয়েছে একের পর এক দুঃখজনক উপাখ্যান, পণ্ডিত-দুর্দশার বারোমাস্যা যার অন্যতম।মন-মেজাজ বিগড়ানোর মারাত্মক ইঙ্গিত উপত্যকা কিন্তু দিয়েছিল ১৯৮৩ সালের ১৩ অক্টোবর। সেদিন বিশ্বজয়ী ভারতীয় ক্রিকেটারদের শ্রীনগরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে খেলায় যেভাবে হেনস্তা হতে হয়, চোখ খুলে দেওয়ার পক্ষে তা যথেষ্ট ছিল। কিন্তু রাজনীতি চলেছিল তার নিজস্ব গতিতে। ইন্দিরা-ফারুক মনোমালিন্য, ’৮৪ সালে ফারুক সরকারের পতন ঘটানো, গুল মহম্মদ শাহকে শিখণ্ডী করে কংগ্রেসের উপত্যকা শাসন, ইন্দিরা নিধন, রাজীব-ফারুক বন্ধুত্ব এবং ১৯৮৭ সালের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি রাতারাতি জন্ম দেয় হিংসার রাজনীতির। ’৮৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে টিকালাল টাপলু, ভূষণলাল রায়না, মোহনলাল, নীলকণ্ঠ গঞ্জুরা যখন খুন হচ্ছিলেন, তখনই সজাগ হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ৮ থেকে ১৩ ডিসেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ সর্বনাশের পথ প্রশস্ত করে দেয়।

দেশের প্রথম মুসলমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সইদের কন্যা রুবাইয়া গুম হন ৮ ডিসেম্বর। ১৩ ডিসেম্বর ছাড়া পান পাঁচ জেলবন্দি জঙ্গির মুক্তির বিনিময়ে। মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন। ইন্দ্রকুমার গুজরাল ও আরিফ মহম্মদ খান তাঁকে বলেছিলেন, জঙ্গিদের মুক্তি না-দিলে সরকারকে বরখাস্ত করা হবে। কাশ্মীরের ললাটলিখন সেদিনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। দশ বছর পর, ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ছিনতাই হওয়া আইসি ৮১৪ বিমান যাত্রীদের মুক্তিপণ হিসাবে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে করে তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী যশবন্ত সিংয়ের কান্দাহার যাত্রা ছিল সেই ললাটলিখনেরই অঙ্গ। আজ যাঁরা ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ নিয়ে উদ্বাহু নৃত্যরত, পালক থেকে হাঁসেরর জল ঝাড়ার মতো দায়মুক্ত তাঁরাও নন। ’৮৯ সালে বিজেপি ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের খুঁটি, ’৯৯-এ অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী।

কাশ্মীরের ‘সত্য’ এসবও। কিন্তু সিনেমায় অনুচ্চারিত। যেমন, অনুদ্‌ঘাটিত- রক্তপিপাসু মুসলমান, দেশপ্রেমিক সেনানী কিংবা ট্রিগার হ্যাপি আধা-সামরিক বাহিনীর হাতে শান্তিপ্রিয় কাশ্মীরি মুসলমানদের নিধনযজ্ঞ। সরকারি তথ্য জানাচ্ছে, উপত্যকায় জঙ্গিদের হাতে তিন দশকে ৮৯ জন কাশ্মীরি পণ্ডিত খুন হয়েছেন। এটা যতটা ‘সত্য’, ততটাই ‘সত্য’ ১ হাজার ৬৩৫ জন কাশ্মীরি মুসলমানের খুন হওয়াও। দেশি-বিদেশি যেসব মানবাধিকার সংগঠনের রিপোর্ট সরকারের গায়ে ছেঁকা দেয়, তা ‘সত্যি’ হলে লক্ষাধিক সাধারণ শান্তিপ্রিয় কাশ্মীরি এই তিন দশকে নিহত। কেউ ‘ফেক এনকাউন্টার’-এ, কেউ সেনা অত্যাচারে, কেউ পুলিশি হেফাজতে, কেউ অতর্কিতে ছোড়া গ্রেনেডে, কেউ জঙ্গি হানায়, কত-শত স্রেফ বেপাত্তা!

সেই ’৯০ সাল থেকে বছর বছর সেনা অত্যাচারের অভিযোগে উপত্যকা তোলপাড় হয়েছে। গাওয়াকাদাল, হান্ডোয়ারা, সোপোর, বিজবেহরা, কুপওয়ারা- অগুনতি অভিযোগ। এমন অভিযোগও প্রমাণিত, পদোন্নতির অদম্য তাড়নায় নিরপরাধ কাশ্মীরিদের হত্যার পর ‘জঙ্গি’ তকমা সাঁটা হয়েছে। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের দুর্দশা যতটা ‘সত্য’, কাশ্মীরি মুসলমানদের দুর্দশাও ততটাই।অসংখ্য সেই দুর্দশার একটা ঘটনা নিয়ে সরকারি আনুকূল্যে তৈরি হয়েছিল এক ছোট্ট তথ্যচিত্র ‘ওশন অফ টিয়ার্স’। ২০১২ সালে। কুপওয়ারা জেলার কুনান ও পশপোড়া গ্রামে তল্লাশির নামে সেনাবাহিনীর ‘গণধর্ষণ’-এর দলিল ছিল তা। ‘পরজানিয়া’ সিনেমা গুজরাতে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞায় আটকে ছিল, ‘ওশন অফ টিয়ার্স’ সর্বত্র।কত ‘সত্য’ কত কাল যে ধামাচাপা থেকে যায়!

[আরও পড়ুন: ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে ভারত কি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিল ?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement