বিশ্বদীপ দে: জেরক্স বলতে আমরা যা বুঝি তা আসলে ফটোকপি মেশিন। 'জেরক্স' একটি সংস্থার নাম মাত্র। কিন্তু সেই নামটি কী করে প্রতিস্থাপিত দিল ফটোকপিকে তা এক বিস্ময়। আসলে যতই বিস্ময়কর মনে হোক, পুরোটাই মার্কেটিংয়ের কামাল। একই ভাবে গত শতকের ছয়ের দশকের শেষভাগে জন্ম নেওয়া এক ওয়াশিং পাউডারও সমনামী হয়ে উঠেছিল সমস্ত ওয়াশিং পাউডারেরই। বিখ্যাত জিঙ্গলটি এমনভাবে সকলের মাথায় বাসা বেঁধে রয়েছে 'ওয়াশিং পাউডার' বললেই অবধারিত ভাবে মনে পড়ে নিরমাকে। দেশের একনম্বর ওয়াশিং পাউডার কী করে 'ডিটারজেন্ট যুদ্ধে' পরাস্ত হয়ে নিজের সাম্রাজ্য খোয়াল তা এক আশ্চর্য কাহিনি। যা আসলে সত্যি হলেও গল্প। যার মধ্যে ধরা রয়েছে ভারতীয় বাজারের জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের উত্থানপতনের অনুপম কথা।
দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরে জন্ম নিরমার
শুরুটা ১৯৬৯ সালে। এক ২৪ বছরের তরুণ বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করতেন হলুদ ডিটারজেন্ট পাউডার বিক্রি করা শুরু করেন। কে জানত মাত্র কয়েক বছরেই সেই তরুণ হয়ে উঠবেন দেশের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্য-সুপ্রিমো! গুজরাটের সেই তরুণের নাম কার্সনভাই প্যাটেল। সরকারি দপ্তরে রসায়নবিদ হলেও রোজগার যথেষ্ট ছিল না। ফলে অতিরিক্ত উপার্জন করার জন্য শুরু করলেন ব্যবসা। সোডা-অ্যাশ ও আরও নানা রাসায়নিক নিয়ে শুরু করলেন পরীক্ষা নিরীক্ষা। শেষপর্যন্ত বাড়িতেই তিনি তৈরি করলেন সাধ্যের মধ্যে কেনা যাবে এমন ডিটারডেন্ট পাউডার। কী রাখা হবে পাউডারের নাম? নিজের এক বছরের ছোট্ট মেয়ে নিরুপমার ডাকনাম নিরমার নামেই হলুদ সেই পাউডারের নামকরণ করলেন কার্সনভাই। দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরের ভিতরে সাড়ে তিন টাকা কেজির ওই পাউডার তৈরি করতেন তিনি। অন্যদিকে সেই সময় বাজার কাঁপানো সার্ফের দাম ছিল তেরো টাকা (মতান্তরে পনেরো) প্রতি কেজি। অর্থাৎ কেজি পিছু সাড়ে নয় বা এগারো টাকা বেশি!
প্রথমে গুজরাটের রূপপুর। নিজের হোমটাউনের ঘরে ঘরে নিরমা পৌঁছে দিতে লাগলেন কার্সনভাই। দৈনিক ১৫-২০ প্যাকেট বিক্রি হতই। নিজেই সাইকেলে চড়ে সেই পাউডার বিক্রি করে বেড়াতেন। কখনও কখনও ১৫ কিমি দূরেও পৌঁছে যেতেন নিরমা নিয়ে। আসলে সার্ফ যতই বাজার দখল করে থাকুক, নামী ব্র্যান্ডের ওই ডিটারজেন্ট নিম্ন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্রদের নাগালের বাইরে ছিল। কিন্তু তাঁরা যে হলুদ সাবান দিয়ে কাপড় কাচতেন তা 'মন্দের ভালো' হলেও 'জেদি' দাগ দূর করা তার কম্মো ছিল না। ফলে তাঁরা যে অপেক্ষাকৃত সস্তা নিরমার দিকেই ঝুঁকবেন সেটাই ছিল স্বাভাবিক। আর এটাই ছিল কার্সনভাইয়ের মাস্টারস্ট্রোক। রাতারাতি আরও দূরে ছড়িয়ে পড়ল নিরমার খ্যাতি। দেখতে দেখতে দৈনিক ২০০ কেজি বিক্রি হতে লাগল ওই ওয়াশিং পাউডার। ততদিনে আর একার সাধ্যের মধ্যে নেই ব্যাপারটা। আলাদা 'শেড' তৈরি করে (কারখানা নয়, খরচ বাঁচাতে ছোট ছোট শেড তৈরি করাই মনস্থ করেন কার্সনভাই) শুরু হল নির্মাণ। কাজে বহাল করা হল বহু তরুণকে।
সব কি পসন্দ নিরমা
এতদিন ওয়াশিং পাউডারের প্যাকেজিং নিয়ে বিশেষ ভাবনাচিন্তা করেননি কার্সনভাই। কিন্তু এবার তিনি প্যাকেট নিয়েও ভাবতে শুরু করলেন। যেহেতু মেয়ের নামেই ব্যবসার ব্র্যান্ড, তাই প্যাকেটের গায়ে নিজের ছোট্ট মেয়ের ফ্রক পরিহিত ছবিকেই বাছলেন কার্সনভাই। আর এই ছবি আঁকার বরাত পেয়েছিলেন এক বঙ্গসন্তান। তিনি ধীরেন্দ্রনাথ শূর। এভাবেই নিরমার ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে গেলেন এক বাঙালি চিত্রশিল্পীও। নিরমা বলতে কেবলই জিঙ্গল নয়, ওই ফ্রক পরিহিত বালিকামূর্তির জলছাপও রয়ে গিয়েছে আসমুদ্রহিমাচলের মানুষের স্মৃতিতে। ১৯৭৫ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওয় বেজে উঠল জিঙ্গল 'নিরমা নিরমা ওয়াশিং পাউডার নিরমা...'। এই গানের কথাও নিরমার জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পিছনে বড়সড় ভূমিকা নিয়েছিল। 'থোড়া সা পাউডার অউর ঝাগ ঢের সারা'। অর্থাৎ অল্প পাউডারের অনেক অনেক ফেনার প্রতিশ্রুতি।
পাশাপাশি 'সব কি পসন্দ নিরমা' কিংবা 'কম কিমত মে অধিক সফেদি' অথবা 'ইসি লিয়ে তো ঘর ঘর মে আয়া নিরমা'র মতো সহজ অথচ কার্যকরী লাইন একেবারে মরমে সেঁধিয়ে গেল ভারতীয় আমজনতার। ১৯৮২ সালে প্রথমবার টিভিতেও দেখা গেল নিরমার বিজ্ঞাপন। জিঙ্গল কিন্তু একই। সঙ্গে পর্দায় ফ্রক পরিহিত বালিকার বাতাসের ভিতরে ঘুরপাকের দৃশ্য। একইভাবে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে গেল এই বিজ্ঞাপনও। ১৯৮৫ সালে প্রায় ৬০ শতাংশ মার্কেট ছিল নিরমারই মুঠোয়। দেশের এক নম্বর ডিটারজেন্ট তখন কার্সনভাইয়ের তৈরি ওয়াশিং পাউডার। কিন্তু 'চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়'... এটা কার্সনভাই হাড়ে হাড়ে টের পান অবিলম্বেই। কেন রকেটগতির উত্থানের পর নিরমার জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করল?
সস্তার জবাবে সস্তাতেই কিস্তিমাত 'হুইলে'র
'সার্ফ'-এর বাজার যেভাবে নিরমা দখল করে নিয়েছিল, সেই বাজার পুনর্দখল করতে হলে যে সস্তাতেই বাজিমাত করতে হবে সেব্যাপারে নিশ্চিত ছিল এইচইউএল। কিন্তু সংস্থাটি জানত সার্ফের যে ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি, তাতে দাম এতটা কমালে 'কোয়ালিটি' আর আগের মতো থাকবে না। কাজেই সার্ফকে সরিয়ে রেখে তারা পরিকল্পনা করল 'হুইলে'র। এই ওয়াশিং পাউডারটির দাম নিরমার মতোই। কিন্তু নিরমায় যা ছিল না এতে সেগুলো ছিল। যেমন সুগন্ধ, হাত জ্বালা না করা কিংবা কাচা কাপড় শুকিয়ে যাওয়ার পরের নরম ভাব। একই দামেই এই অতিরিক্ত পাওনাগুলোই ক্রেতাদের মন জিতে নিল। তরতরিয়ে গড়াতে শুরু করল 'হুইলে'র চাকা। এমনকী বিজ্ঞাপনেও খোঁচা দেওয়া হতে লাগল নিরমাকে। ১৯৯০ আসতে না আসতেই নিরমার ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলতে শুরু করে দিল হুইল। দেশের দ্বিতীয় সবচেয়ে বিক্রি হওয়া ওয়াশিং পাউডার হয়ে। এপ্রসঙ্গে মনে পড়বেই ললিতাজিকে। বিখ্যাত সিরিয়াল 'উড়ান'-এর নায়িকা কবিতা চৌধুরী ছিলেন বিখ্যাত সেই বিজ্ঞাপনের ভারতীয় গৃহবধূর চরিত্রে। যিনি দর্শককে মনে করিয়ে দিতেন, কেন সার্ফ কেনা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। অর্থাৎ হুইলের সাফল্যের সঙ্গে সার্ফের বিক্রি আরও বাড়িয়ে নিরমার উপরে জোড়া চাপ দেওয়া শুরু হল।
আর সেই সময়ই বাজারে এল 'ঘড়ি' ডিটারজেন্ট পাউডার। কোনও বড় বড় দাবি নয়, যার সাফ কথা ছিল 'পহেলে ইস্তেমাল করে ফির বিশওয়াস করে।' অর্থাৎ নিজেরা ব্যবহার করে দেখে নিন, বিজ্ঞাপনী বুলিতে খামোখা বিশ্বাস করার দরকার নেই। দাম সামান্য বেশি, তবু কানপুরের সংস্থা আরএসপিএলের তৈরি সেই ডিটারজেন্ট বাজারে এসেই ঝড় তুলে দিল। ১৯৮৮ সালে আত্মপ্রকাশ করা সেই ব্র্যান্ড আজ ২০ হাজার কোটি টাকার পণ্য। কোনও বড় সেলেব্রিটিকে দিয়ে বিজ্ঞাপন না করিয়েও যে দ্রুত সর্বভারতীয় বাজার দখল করে নেওয়া যায়, তার প্রমাণ 'ঘড়ি'। অন্যদিকে দ্য প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের 'এরিয়েল'ও বাজারে এসে গেল।
অথচ এমন ঝড়ের মধ্যে কার্সন ছিলেন অবিচল। বলা যায়, তিনি নিরমারে প্যাকেজিং বা বিজ্ঞাপন বদলে কোনও চমক দেওয়ার তেমন কোনও চেষ্টাই করেননি। ফলে যত সময় গিয়েছে, ততই গুরুত্ব হারিয়েছে ওই ওয়াশিং পাউডার। আজও সে রয়েছে বটে। কিন্তু অতীত দিনের সেই একচ্ছত্রাধিপত্যের লেশমাত্রও নেই। যদিও নিরমা অন্যান্য ক্ষেত্রে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। কিন্তু ওয়াশিং পাউডারের সাম্রাজ্য় আর সে ফিরে পায়নি।
