বুদ্ধদেব সেনগুপ্ত, মাদুরাই: 'সীতা ধ্যান, সীতা জ্ঞান, সীতা চিন্তামণি/ সীতা বিনা আমি যেন মণিহারা ফণী।’ মাদুরাইয়ের তিলাক্কম ময়দানের ছবি দেখে কৃত্তিবাস রচিত 'রামের বিলাপ' কবিতার কান্নাভেজা ছত্রের কথাই মাথায় আসে। এখানে অবশ্য সীতা বলতে বোঝাচ্ছে সিপিএমের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি কথা। বোধহয় ক্রমশ বিলীয়মান সিপিএম দলের শেষ অবলম্বন ছিলেন তিনি। যে মানুষটার থাকা আর না থাকার ফারাক বড়ই স্পষ্ট হয়ে প্রতীয়মান মাদুরাই পার্টি কংগ্রেস। সীতা-হীন রামরাজ্যে সবই যেন ছন্নছাড়া। দায়সারা। সব আছে। লাল পতাকা। দেশ-বিদেশের নেতানেত্রী। শৃঙ্খলাবদ্ধ রেড ভলান্টিয়ার বাহিনী। মিটিং, মিছিল, সেমিনার। কিন্তু তারপরও যেন সব কিছু ছন্নছাড়া। সেই দেহাতি প্রবাদের মতো - ঘি যতই ঢালো, রাঁধুনি আনকোরা হলে বিরিয়ানি মুখে রোচে না।
তিলাক্কাম ময়দানের সাজসজ্জা। নিজস্ব চিত্র।
পার্টি কংগ্রেস মানেই বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। দেশ ও বিদেশের কয়েক হাজার প্রতিনিধি, পার্টির প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক, দর্শক ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি। আলোচনা, পাল্টা আলোচনা বা সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক। এর বাইরেও থাকে সেমিনার, প্রদর্শনী, মিটিং-মিছিলের পাশাপাশি হাজার হাজার মানুষের পছন্দের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। পাঁচদিন ধরে এই 'রাজসূয় যজ্ঞ' সফলভাবে উতরে দিতে কয়েকশো স্বেচ্ছাসেবক দিনরাত এক করে দেন। এবারও সেই ব্যস্ততার কোনও খামতি নেই। কিন্তু সব থেকেও যেন নেই। দায়িত্বপ্রাপ্ত সকলেই নিজেদের দায়িত্বে অবিচল। অথচ সবকিছু চলছে কেমন অগোছালো ভঙ্গিতে।
মাদুরাইয়ে সিপিএমের পার্টি কংগ্রেস। নিজস্ব চিত্র।
কারণটা কী? প্রশ্নটা শেষ হওয়ার আগেই উত্তর চলে আসছে যন্ত্রের মতো। একবাক্যে সকলেই যা বলছেন, তা একটাই - সীতারাম ইয়েচুরির অনুপস্থিতি। বিশদ ব্যাখ্যায় যা জানা যাচ্ছে, তা হল, যতদিন ইয়েচুরি পার্টির শীর্ষে ছিলেন, ততদিন সব বিষয়ে নজর থাকত তাঁর। কোনও অনুষ্ঠানে বাড়ির বড়কর্তার নজরদারির মতোই। বাজার করা থেকে অনুষ্ঠানে অতিথি আপ্যায়ণ - সবেতেই। এবার মাদুরাইয়ের পার্টি কংগ্রেসে সীতার অনুপস্থিতি বাড়ির সেই বড় কর্তার কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। কতটা প্রভাব ফেলছে সীতারামের অনুপস্থিতি? কর্মী-স্বেচ্ছাসেবকরা আকারে, ইঙ্গিত বা সামান্য দু-চার শব্দে যেটুকু প্রকাশ করছেন, তাতে স্পষ্ট যে ছোটখাটই নয়, অনেক বড় সমস্যার সমাধানের জন্যও কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। যা একা হাতে নিমেষে সমাধান করে দিতেন ইয়েচুরি।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক! এবার পার্টি কংগ্রেসে অতীব চেনা ছবি, পানীয় জলের সন্ধানে সবার দৌড়াদৌড়ি। এপ্রিলের তামিলনাড়ুতে গরমটা ভালই পড়ে। ফলে প্রবল চাহিদা পানীয় জলের। আর তা খুঁজতে আগত অতিথিদের হা-পিত্যেশ করে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। এর আগে এসব ক্ষেত্রে ‘মুশকিল আসান দাদা’ ছিলেন ইয়েচুরি। আর এসব সামলেই পার্টি কংগ্রেসের খবরাখবর সুচতুরভাবে পৌঁছে দিতেন সংবাদমাধ্যমের কাছে। তিনি জানতেন, এত বড় কর্মযজ্ঞের কথা মানুষই যদি জানতে না পারে, তাহলে সবই বৃথা। তাই দিনের শেষ সাংবাদিকরা ঘরে ফেরার আগে প্রয়োজন মতো খবরে যে ‘বাজার’ করে হোটেলে ফিরতেন, তার মশলার জোগান দিতেন সেই সীতারাম!
পার্টি কংগ্রেসে সিপিএম নেতৃত্ব। নিজস্ব ছবি।
এবারের পার্টি কংগ্রেস তাঁর অভাব বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে। আরও একটি বিষয় নজর কেড়েছে এবার। পার্টি কংগ্রেস উপলক্ষে বাঁধাধরা নিয়মে সব কিছু হলেও সীতারাম ইয়েচুরিকে নিয়ে কোনও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়নি। তাই অসন্তুষ্ট সকলে। এমন একজন মানুষকে এত তাড়াতাড়ি মুছে দেওয়ার চেষ্টা কেন? উঠেছে প্রশ্ন।