বিশ্বদীপ দে: কাতার বিশ্বকাপ (Qatar World Cup 2022) শেষ ধাপে পৌঁছে গিয়েছে। ফুটবল জগতের আনন্দযজ্ঞে এবারও ঠাঁই হয়নি ভারতের। প্রতিবারই এই আপসোস সঙ্গী থাকে আমাদের। প্রশ্ন ওঠে, আর কতদিন প্রায় দেড়শো কোটি ছুঁই ছুঁই এই দেশ ব্রাত্য থেকে যাবে বিশ্বকাপ ফুটবল থেকে? প্রশ্নটা সহজ হলেও উত্তর জানা নেই। তবে ভারতীয় দল বিশ্বকাপে কখনও না খেললেও ভারতীয়রা কিন্তু অংশ নিয়েছেন বিশ্বকাপে! শুনতে যতই ধাঁধার মতো মনে হোক, এটা সত্য়ি। বিশ্বকাপ ফুটবল ও ভারত- এই যোগসূত্রের নাম প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি (Priya Ranjan Dasmunshi) ও কমলেশ্বর শংকর। এঁদের মধ্যে দ্বিতীয় জন ছিলেন বিশ্বকাপ খেলানো একমাত্র ভারতীয় রেফারি। আর প্রথম জন বিশ্বকাপের ভারতীয় ম্যাচ কমিশনার। এই লেখায় ফিরে দেখা যাক সেই গর্বের ইতিহাস।
কমলেশ্বর শংকর (Komaleeswaran Shankar)। ২০০২ বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন সহকারী রেফারি। খেলিয়েছিলেন তিনটি ম্যাচ। সেবারের বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিল জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। সেই প্রতিযোগিতায় মেক্সিকো বনাম ক্রোয়েশিয়া, বেলজিয়াম বনাম তিউনিশিয়া, বেলজিয়াম বনাম রাশিয়া- এই তিনটি ম্যাচে সহকারী রেফারির দায়িত্বে ছিলেন শংকর। অথচ রেফারি হওয়ার কথাই ছিল না তাঁর। চেয়েছিলেন কোচ হতে। কিন্তু এক বন্ধুর উৎসাহে শেষ পর্যন্ত রেফারি হওয়ার পথেই এগোন তিনি। ১৯৯৪ সালে জাতীয় রেফারি হওয়ার পরে আন্তর্জাতিক ময়দানে প্রবেশ করে ১৯৯৫ সালে। সেবার সাফ গেমস খেলানোর সুযোগ পান তিনি। এরপর ক্রমশ এগিয়ে চলা। অবশেষে ২০০২ সালের বিশ্বকাপে সুযোগ পান বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ ময়দানে আত্মপ্রকাশের। যদিও তার আগে বহুদিন ধরেই তিনি ফিফার প্যানেলে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত সুযোগ ২০০২ বিশ্বকাপে।
[আরও পড়ুন: ‘সরকারি কর্মীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্তে প্রত্যক্ষ প্রমাণের প্রয়োজন নেই’, জানাল সুপ্রিম কোর্ট]
কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? জানা যায়, জাপানের নিলগাতা স্টেডিয়ামে মেক্সিকো বনাম ক্রোয়েশিয়া ম্যাচটি খেলানোর আগে আবেগে ভেসে গিয়ে কেঁদেই ফেলেছিলেন শংকর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ওই ম্যাচ এবং পরের ম্যাচগুলি খেলিয়েছিলেন দক্ষ পেশাদারের মতোই। বাইরের আবেগ তাঁর মনঃসংযোগে চিড় ধরাতে পারেনি। বছর কয়েক আগে এক সাক্ষাৎকারে শংকর জানিয়েছিলেন, ”আমি খুবই উত্তেজিত ছিলাম বটে ফুটবলের মহান নামগুলির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। কিন্তু একবার খেলা শুরু হয়ে গেলে কেবল কাজেই ফোকাস করতাম। ভাবতে ভাল লাগে আমার কোনও সিদ্ধান্ত নিয়েই বিতর্ক হয়নি। আমি আমার স্বপ্নকে ছুঁতে পেরেছিলাম।”
গত শতকের সাতের দশক থেকেই প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি প্রবেশ করে রাজনীতির আঙিনায়। এক সময়ে প্রিয়-সুব্রত জুটি ছিল বাংলার রাজনীতির মাইলস্টোন। কিন্তু ভারতীয় ফুটবলেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। দীর্ঘদিন এআইএফএফ সভাপতি থাকার পাশাপাশি বিশ্বকাপে দু’টি ম্যাচে কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০০৬ বিশ্বকাপের আসর বসেছিল জার্মানিতে। সেখানেই জোড়া ম্যাচ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ভার তাঁর উপরেই ছিল। এই দায়িত্ব পালন নিঃসন্দেহে বিপুল গৌরবের। কেননা একটি ফুটবল ম্যাচে কমিশনারের দায়িত্ব কম নয়। তাঁর দায়িত্ব থাকে যেন ম্যাচটিতে কোনও সমস্যা না হয়।
[আরও পড়ুন: তাওয়াংকে ভারতে অন্তর্ভুক্তই করতে চাননি নেহরু! বিস্ফোরক অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী]
প্রিয়রঞ্জন প্রথমে স্পেন ও তিউনিশিয়ার ম্যাচটিতে কমিশনারের ভূমিকা পালন করেন। সেই খেলায় স্পেন ৩-১ গোলে জয়ী হয়। তবে তাঁর দ্বিতীয় ম্যাচটি ছিল এক ঐতিহাসিক ম্যাচ। ক্রোয়েশিয়া বনাম অস্ট্রেলিয়া। কেন এই ম্যাচ ঐতিহাসিক? কেননা এই ম্যাচেই ব্রিটিশ রেফারি গ্রাহাম পল ক্রোয়েশিয়ার জোসিপ সিমুনিককে তিনটি হলুদ কার্ড দেখিয়েছিলেন! কেবল পুরুষদের বিশ্বকাপই নয়, মহিলাদের বিশ্বকাপেও কমিশনারের দায়িত্ব সামলেছিলেন রাজনীতির ময়দানে কংগ্রেসের ডাকসাইটে এই নেতা। ১৯৯৯ সালের মহিলা বিশ্বকাপে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। এখানেই শেষ নয়। ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সে আয়োজিত বিশ্বকাপেরও অংশ ছিলেন তিনি। তবে কমিশনার হিসেবে নয়। এছাড়াও পরে তিনি এএফসির লিগ্যাল কমিটির প্রধানের দায়িত্ব সামলেছিলেন। পাশাপাশি ফিফার স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যও ছিলেন প্রিয়রঞ্জন।
এসবই আজ ইতিহাস। শংকর কিংবা প্রিয়রঞ্জনের ঐতিহ্যকে আর কেউ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। ভারতেরও বিশ্বকাপ কানেকশনের রেকর্ড গাথা ওখানেই থমকে গিয়েছে। অথচ ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছিল ভারত। ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া ও বর্মা নাম তুলে নেওয়ায় ভারতের কাছে সুযোগ চলে আসে। কিন্তু বিশ্বকাপ শুরুর অব্যবহিত আগেই ভারত জানিয়ে দেয়, তাদের পক্ষে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া সম্ভব ছিল না। এর ঠিক দু’বছর আগে, ১৯৪৮ সালে অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিল ভারত। কিন্তু নানাবিধ কারণে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েও পিছিয়ে আসে এআইএফএফ। আসল কারণ সম্ভবত বিশ্বকাপকে গুরুত্ব দিতে না চাওয়া। এবিষয়ে সবচেয়ে প্রচলিত থিয়োরি হল তখনও ভারতীয় ফুটবলাররা খালি পায়েই খেলতে অভ্যস্ত। বুট পরে খেলতে চাননি তাঁরা। কিন্তু এই থিয়োরিকে নাকচ করে দিয়েছিলেন শৈলেন মান্না।তৎকালীন ভারত অধিনায়ক জানিয়ে দিয়েছিলেন, বিশ্বকাপে না খেলতে চাওয়ার কারণ এটা ছিল না।
তবে কারণ যাই হোক, ভারত কখনও ডাক পায়নি বিশ্বকাপে। পরবর্তী সময়ে যে দীর্ঘশ্বাস প্রতি চার বছর অন্তর ফিরে ফিরে এসেছে, সেখানে উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে রয়ে গিয়েছে শংকর ও প্রিয়রঞ্জনের কীর্তি। তবে ভারতে খেলে গিয়েছেন বহু বিশ্বকাপার। তাঁদের মধ্যে প্রথম নাম মাজিদ বাসকার। ১৯৭৮ সালে ইরানের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে ছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ইস্টবেঙ্গল ও মহামেডান স্পোর্টিংয়ের হয়ে খেলতে কলকাতায় আসেন মাজিদ। তৈরি করেন ময়দানের অনন্য রূপকথা। এপ্রসঙ্গে মনে পড়তে পারে এমেকার কথাও। তিনি ভারতে খেলে যাওয়ার পরে নাইজিরিয়ার হয়ে বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েছিলেন। এমন উদাহরণ আরও রয়েছে। কিন্তু বিশ্বকাপাররা ভারতে খেলে গেলেও ভারতের বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন সুদূরই থেকে গিয়েছে।