শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাঙ্ক, হাসপাতাল থেকে সেলিব্রিটি–সকলেই এখন পাবলিক রিলেশন অফিসার রাখে। সে কথাই জানালেন মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজের সাংবাদিকতা ও গণজ্ঞাপন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ দাস শুনলেন অনিন্দ্য সিংহচৌধুরী।
একটা সময় পর্যন্ত ভাবা হত যে, কর্পোরেট কোম্পানির ব্যবসা বাড়ানোর জন্য শুধুই ‘মূলধন’ প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ব্যবসা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শুধুই ‘অর্থ’ নয়, ভীষণভাবে দরকার জনমানসে উজ্জ্বল ‘ভাবমূর্তি’ গড়ে তোলা। এবং তা অবশ্যই বজায় রাখা। আর এই ভাবমূর্তি বা ‘ইমেজ’ তৈরি করতেই প্রয়োজন হয় ‘পিআর’ বা ‘পাবলিক রিলেশন’-এর। বাংলায় যাকে বলে ‘জনসংযোগ’। এটা মানতেই হবে, যে কোম্পানির সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে ‘পিআর’ ভাল, সেই কোম্পানি অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যবসা দুরন্ত গতিতে এগিয়ে নিয়ে যায়। আর মানুষের মনে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি গড়ে তোলার কাজটাই নিরন্তর করে যান ‘পাবলিক রিলেশন অফিসার’। আসলে, এটা কিন্তু একদিনের কাজ নয়, এটা বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা। এটা কোনও কোম্পানি নিজের চেষ্টায় সুনাম অর্জন করতে পারে না। এমনকী, কোনও কোম্পানির সংকটের সময় পাবলিক রিলেশন অফিসাররাই ‘রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়ান।
তবে এখন শুধু কোম্পানি নয়, সেলিব্রিটি থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক-সব জায়গাতেই পাবলিক রিলেশন অফিসার বা ‘পিআরও’-দের ব্যাপক চাহিদা। দারুণ কদর। তাই তো এখন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ‘পিআরও’ হওয়ার দিকে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। আসলে, জনসংযোগ বা পিআরও, এই পেশায় যেমন আছে সম্মান, তেমনই আছে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি।
সরকারি ক্ষেত্রে: এখন তো কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকারি নানা দপ্তরের কাজকর্ম সংবাদমাধ্যমকে জানানোর জন্য কিংবা দপ্তরের সুনাম বাড়ানোর জন্য পাবলিক রিলেশন অফিসার নিয়োগ করে।
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়: বিশেষ করে বেসরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য থেকে শুরু করে নানা অনুষ্ঠানের ‘খবর’ সংবাদমাধ্যমকে জানানো জন্য ও ছাত্রছাত্রী-অভিভাবক মহলে সুনাম বাড়ানোর জন্য ‘পিআরও’ নিয়োগ করে।
হাসপাতাল থেকে ব্যাঙ্কিং সেক্টরে: বেসরকারি ব্যাঙ্ক বা হোটেল-রেস্তরাঁ থেকে হাসপাতাল বা নার্সিং হোমের নানা কাজকর্ম যাতে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যায়, সেজন্য এখন প্রত্যেকটি বেসরকারি হাসপাতাল-নার্সিংহোম থেকে ব্যাঙ্ক পাবলিক রিলেশন অফিসার রাখে।
ব্যবসায়ী-সেলিব্রিটি ‘পিআরও’ রাখে: বলিউড থেকে টলিউড বা হলিউড, অভিনেতা-অভিনেত্রী বা বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতি-সকলেই এখন পাবলিক রিলেশন অফিসার রাখছে।
পরিবহণ ক্ষেত্রে: রেল থেকে মেট্রো ট্রেন বা এখনকার লাক্সারি বাসের পরিষেবা সম্পর্কে জনগণকে জানানোর দায়িত্ব থাকে জনসংযোগ আধিকারিকদের। পরিবহণ ক্ষেত্রে বহু পড়ুয়াই পিআরও হিসাবে কাজ দিয়েছে, দিচ্ছেও।
এজেন্সিতে কাজের সুযোগ: বর্তমানে এরাজ্যে তো বটেই, দেশের নানা পিআর এজেন্সি রয়েছে, সেখানেও একেবারে শুরুতে কাজের সুযোগ রয়েছে। সেখানেও উচ্চপদে যাওয়ার সুযোগ আছে।
[আরও পড়ুন: নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে বোর্ড-জয়েন্ট-নিট পরীক্ষার প্রস্তুতি কীভাবে নেয় পড়ুয়ারা?]
রাজ্যেই পড়ার সুযোগ
মনে রাখা প্রয়োজন, পাবলিক রিলেশন আসলে পেশাগত শিক্ষা। জনসংযোগ শিক্ষা আলাদা করে সেভাবে পড়ানোর সুযোগ নেই। তবে স্নাতক স্তরে সাংবাদিকতা ও গণজ্ঞাপন বিষয়ের একটা অংশ হিসাবে জনসংযোগ পড়ার সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নানা কলেজে স্নাতক পড়া যায়, যেমন বাগবাজার উইমেন্স কলেজ, আশুতোষ কলেজ, মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজ, মুরলীধর গার্লস কলেজ, বিদ্যাসাগর কলেজ, বিজয়গড় জ্যোতিষ রায়, নিউ আলিপুর কলেজ। পাশাপাশি, ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইউনিভার্সিটি, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজেও সাংবাদিকতা পড়া যায়। বর্তমানে রাজ্যের বহু বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও জার্নালিজম পড়া যায়।
স্নাতকের পর পাবলিক রিলেশনে ডিপ্লোমা করার সুযোগ রয়েছে কলকাতার ‘ভবনস’-এ, আইআইএম দিল্লি ও ডেঙ্কালন। বলা প্রয়োজন, সাংবাদিকতায় মাস্টার্স ডিগ্রি পড়ার সময়ও পাবলিক রিলেশন একটা আবশ্যিক পেপার রয়েছে। এক্ষেত্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বাগবাজার উইমেন্স কলেজ, বধর্মান, যাদবপুর ও উত্তরবঙ্গ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি করা যায়। একটা বিষয় জানা প্রয়োজন, শুধু সাংবাদিকতা নয়, স্নাতক স্তরে ইংরেজি বা অন্য বিষয় নিয়ে পড়েও পাবলিক রিলেশন পেশায় যেতেই পারে। এমনকী, কারও যদি বর্তমান ‘মাইনর’ সাবজেক্টে জার্নালিজম থাকে, তাহলেও জনসংযোগের মৌলিক বিষয়গুলি জানতেই পারবে।
অ্যাড-অন কোর্স
কাজের বাজারে পাবলিক রিলেশনের চাহিদা থাকায় অনেক কলেজ ‘অ্যাড-অন কোর্স’ হিসাবে এই বিষয়টি পড়ানোর পরিকল্পনা করছে, তার মধ্যে রয়েছে নব বালিগঞ্জ কলেজ, বাগবাজার উইমেন্স কলেজ। এখানে এই বিষয়ের অভিজ্ঞ শিক্ষক ও পেশাগত কর্মীরা যুক্ত।
ইন্টার্নশিপের সুযোগ
অনেকেই স্নাতক বা মাস্টার্স ডিগ্রিতে বহু ছাত্রছাত্রীই পাবলিক রিলেশনে ইন্টার্নশিপ করে। অনেকেই ইন্টার্নশিপ করতে করতেই কাজ পেয়ে যায়।
নিজের প্রস্তুতি জরুরি
দক্ষ পাবলিক রিলেশন অফিসার হতে গেলে প্রথমে মনোমুগ্ধকর ব্যক্তিত্ব হওয়া প্রয়োজন, যার সঙ্গে সহজেই কথা বলা যাবে। নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষমতা অর্থাৎ সুন্দরভাবে কথা বলা, নানা ভাষায় লিখতে ও বলতে পারবে, বিশেষ করে ডিজিটাল মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করতে পারার দক্ষতা থাকবে, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার দক্ষতা থাকবে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে ঠান্ডা মাথায় মোকাবিলা করার ক্ষমতা থাকবে। সঙ্গে ‘মাল্টি টাস্কিং’ হওয়া বিশেষ প্রয়োজন, অর্থাৎ একসঙ্গে অনেক কাজ সুন্দর করে গুছিয়ে শেষ করার দক্ষতা থাকতেই হবে।
সবশেষে যেটা বলতে হয়, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সারা বছর ধরেই সম্পর্ক বজায় থাকা প্রয়োজন।